গাব্বু বলল, “আমার।” নিজের জিনিসটা নেওয়ার জন্যে সে হাত বাড়াল, প্রিন্সিপাল স্যার লেন্সটা ফেরত না দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে বললেন, “ও! আমাদের রেগুলার ক্রিমিনাল! তোমার?”
“জি স্যার।”
“ঘরে আগুন লাগানোর জন্যে জানালায় ফিট করেছ?”
“না স্যার। মিলি আর লিটন কনভেক্স লেন্স নিয়ে কথা বলছিল-”
“খবরদার।” প্রিন্সিপাল স্যার খেঁকিয়ে উঠলেন, “নিজের বদমাইশির সাথে অন্যদের জড়াবে না। আর কী কী করেছ তুমি?”
“কিছু করি নাই স্যার।”
“নিশ্চয়ই করেছ। বল কী করেছ?”
“কিছু করি নাই।”
প্রিন্সিপাল স্যার এবারে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকালেন, বললেন, “কী করেছে তোমরা বল।”
কেউ কোনো কথা বলল না। প্রিন্সিপাল স্যার এবার ধমক দিয়ে বললেন, “কী করেছে বল?”
লিটন একটু ইতস্তত করে বলল, “গাব্বু তো একটু পাগল কিসিমের, তাই সবসময়েই কিছু না কিছু করছে।”
“কী করেছে?”
“এই তো–”
“এই তো মানে?”
মিলি বলল, “যেমন চিমটি কাটা–”
প্রিন্সিপাল স্যার চিৎকার করে বললেন, “চিমটি কেটেছে? এই মিচকি শয়তান চিমটি কাটে? কত বড় সাহস? আর কী করে?”
গাব্বু আবিষ্কার করল প্রিন্সিপাল স্যার ধমকাধমকি করে কিছুক্ষণের মাঝে ফারিয়ার চুল কাটা থেকে শুরু করে রত্নাকে মাকড়সা দিয়ে ভয় দেখানো পর্যন্ত সবগুলো ঘটনা বের করে ফেললেন। তার মুখে এবারে কেমন যেন একটা আনন্দের ছাপ পড়ল, তার মুখের দুই পাশের ধারালো কেনাইন দাঁত দুটো বের করে হিংস্র মুখে বললেন, “মিচকে শয়তান! তোমার দিন শেষ! ফিনিস।”
গাব্বু বলল, “আ-আমার?”
“হ্যাঁ। তোমার কত বড় সাহস, তুমি আমাকে হাইকোর্ট দেখাও? এখন আমি তোমাকে হাইকোর্ট দেখাব।”
গাব্বু বলল, “হাইকোর্ট? আমাকে?”
প্রিন্সিপাল স্যার মাথা ঝাঁকালেন, কিন্তু যেহেতু তার গলা নেই, শরীরের ওপর মাথাটা সরাসরি বসানো, তাই মাথাটা খুব বেশি নড়ল না। সেই অবস্থায় হিস হিস শব্দ করে বললেন, “আমি তোমার বাবা-মা’কে ডেকে পাঠাচ্ছি, তারপর তাদের হাতে তোমাকে তুলে দিব। তারা তোমাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন।”
গাব্বু বলল, “যা ইচ্ছা?”
“হ্যাঁ। যা ইচ্ছা।”
৯-১০. স্কুল থেকে টেলিফোন
স্কুল থেকে টেলিফোন পেয়ে আব্বু আর আম্মু দুজনেই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, তাদের তিনজন ছেলেমেয়ে এই স্কুলে পড়ে, তাই প্রথমেই তাদের মনে হয়েছে যে তাদের কারও কিছু একটা হয়েছে। স্কুল থেকে বলা হল তার ছেলেমেয়ের কারও কিছু হয়নি, তাদের ডাকা হয়েছে সম্পূর্ণ অন্য কোনো কারণে। কারণটা কী টেলিফোনে তাদের বলা হয়নি, কিন্তু আব্বু বা আম্মু কারোই কারণটা অনুমান করতে কোনো সমস্যা হয়নি।
স্কুলে এসে প্রিন্সিপালের অফিসে ঢুকে দেখলেন তাদের অনুমান সত্যি। প্রিন্সিপাল তাদের দুইজনকে দেখে মুখটা কালো করে ফেললেন, তারপর হতাশভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগলেন। প্রিন্সিপাল সাইজে ছোট, ধড়ের ওপর মাথাটা সরাসরি বসানো এই বর্ণনাটা তাদের ছেলেমেয়ের কাছ থেকে অনেকবার শুনেছেন, আজকে নিজের চোখে দেখলেন।
আবু বললেন, “স্কুল থেকে আমাদের দুইজনকে ডেকে পাঠিয়েছেন?”
“হ্যাঁ। আপনারা গাব্বুর বাবা-মা?”
“জি।”
“বসেন।”
আব্বু আর আম্মু বসলেন। আব্বু কেশে গলাটা একটু পরিষ্কার করে বললেন, “আপনি আমাদের কেন ডেকে পাঠিয়েছেন আমরা বিষয়টা একটু অনুমান করতে পারছি। বিষয়টা নিশ্চয়ই গাকে নিয়ে তার কোনো একটা এক্সপেরিমেন্ট”
প্রিন্সিপাল আব্বুকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “না, না। আপনাদের সবকিছু জানা দরকার। নিজের চোখে দেখা দরকার, নিজের কানে শোনা দরকার। বাবা-মায়েরা সবসময় ভাবে তাদের ছেলেমেয়েরা হচ্ছে ফিরেশতা, তারা কোনো ভুল করতে পারে না। তাদের ধারণা, আমরা শিক্ষকেরা তাদের ছেলেমেয়েদের ওপর অবিচার করি।”
আব্বু বললেন, “না, না। আমরা কখনোই সেটা ভাবি না।”
প্রিন্সিপাল গলা উঁচিয়ে বললেন, “ভাবেন। নিশ্চয়ই ভাবেন। সেই জন্যে আমি আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছি। নিজের চোখে দেখেন, নিজের কানে শোনেন আপনার ছেলে কী করেছে।”
আম্মু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী করেছে গাব্বু?”
প্রিন্সিপাল একটা কাগজ তুলে বললেন, “এই যে এখানে লেখা আছে। শুধু আজকের ঘটনা, এক দুই তিন চার পাঁচ ছয়–ছয়টা ঘটনা। বলতে পারেন ছয়টা ক্রিমিনাল অফেন্স।”
আম্মু চোখ কপালে তুলে বললেন, “ক্রিমিনাল অফেন্স?”
“অবশ্যই। আপনার ছেলে যদি ছোট না হয়ে বড় হত তা হলে এতক্ষণে পুলিশ ধরে নিয়ে যেত।”
আম্মু খাবি খেলেন, “আমাদের গাব্বুকে পুলিশে ধরে নিয়ে যেত?”
“আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই। নিজের চোখে দেখেন, নিজের কানে শোনেন।” প্রিন্সিপাল স্যার তখন গলা উঁচিয়ে একজন মানুষকে ডেকে বললেন রওশন ম্যাডাম, তার ক্লাসের ছেলেমেয়ে আর গাকে ডেকে আনতে।
কিছুক্ষণের মাঝেই প্রথমে গাব্বু, তার ক্লাসের বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে এবং সবার শেষে রওশন ম্যাডাম প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকলেন। রওশন ম্যাডাম একটা চেয়ারে বসলেন। গাব্বু এবং তার ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে এক কোনায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
প্রিন্সিপাল স্যার গলা উঁচিয়ে বললেন, “গালু, তুমি মাঝখানে দাঁড়াও।”
গাব্বু মাঝখানে দাঁড়াল, সে তার বড় চশমার ভেতর দিয়ে ভয়ে ভয়ে একবার আব্বু-আম্মুর দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেলল।