ফারিয়া একটু লাজুক ভঙ্গিতে হেসে বলল, “হ্যাঁ। আমার চুল অনেক লম্বা।”
“আমাকে একটু দিবি?”
ফারিয়া গাব্বুর কথা ঠিক বুঝতে পারল না, বলল, “কী দিব?”
“তোর চুল।”
“চুল? চুল দিব? চুল কীভাবে দেয়?”
“কেটে?”
গাব্বু তার সুন্দর লম্বা চুল লক্ষ করেছে শুনে একটু আগে তার ভেতরে যে একটু ভালো অনুভূতি হয়েছিল, এখন তার পুরোটা দূর হয়ে সেখানে একটা খাট্টাভাব তৈরি হল। ফারিয়া রেগেমেগে বলল, “তুই জানিস যে তোর মাথা খারাপ?”
“দে না। প্লীজ। একটু।”
“দূর হ।”
গাব্বু দূর হল না, সে ফারিয়ার পিছনে লেগে রইল, আর শেষ পর্যন্ত ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ফারিয়া তাকে কয়েকটা চুল দিতে রাজি হল। সাথে সাথে গাব্বু এক দৌড়ে তার ব্যাগ থেকে একটা কাঁচি নিয়ে চলে আসে।”
ফারিয়া চোখ কপালে তুলে বলল, “কাঁচি কেন?”
“চুল কাটার জন্যে।”
“কতগুলো কাটবি?”
“বেশি না, গুনে গুনে দশটা।”
চুল গুনে গুনে কাটা যায় কি না সেটা এখনো কেউ জানে না এবং আট নম্বর চুলটা কাটার সময় ফারিয়া আবার মাথায় একটা ঝটকা দিল আর তখন তার মাথার একগোছা চুল কাটা পড়ল।
ফারিয়ার মাথায় অনেক চুল, কাজেই যেখানে একগোছা চুল কাটা পড়েছে সেই জায়গাটা সহজেই ঢেকে রাখা যায় কিন্তুচুল একটু সরালেই ফাঁকা জায়গাটা চোখে পড়ে। ফারিয়ার মেজাজ যা খারাপ হল সেটা বলার মতো না, কিন্তু তখন কী করবে!
ক্লাসের ঘণ্টা পড়ার পর রত্না ভয়ে ভয়ে ক্লাসে ঢুকল। গাব্বু তার ব্যাগের ভেতর একটা জ্যান্ত মাকড়সা রেখে দিয়েছে, সেটা চিন্তা করেই তার বুক ধুকধুক করছে। গাব্বুর বেঞ্চ থেকে অনেক দূরে গিয়ে বসে সে চিৎকার করে বলল, “গাব্বু, তোকে আমি খুন করে ফেলব।”
গাব্বু একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“তুই জানিস না কেন? তুই জানিস না আমি মাকড়সাকে ভয় পাই? আমাকে মাকড়সা দিয়ে ভয় দেখাস?”
গাব্বু আরও একটু অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু আমি তো ভয় দেখানোর জন্যে মাকড়সা দেখাইনি। মানুষ ভয় পাওয়ার সময় তার সামনে যেটা হয় সেটা মনে রাখে। সেই জন্যে দশমিকের পর নয় ঘর পাইয়ের মান বলছিলাম, লক্ষ করিসনি?”
পাইয়ের মান নিয়ে রত্নার খুব একটা মাথা ব্যথা দেখা গেল না। সে হিংস্র গলায় বলল, “আমি প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে নালিশ করব।”
গাব্বু বলল, “কিন্তু কিন্তু–”
“আমি থানায় তোর বিরুদ্ধে মামলা করব।”
গাব্বু বলল, “কিন্তু আমি–”
“তোর আব্বু-আম্মুর কাছে নালিশ করব।”
গাব্বু বলল, “আসলে হয়েছে কী জানিস, মানুষের ব্রেনের মাঝে-”
ভয় পেলে মানুষ কেমন করে সেটা মনে রাখে বিষয়টা গাব্বু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার মাঝে ক্লাসে রওশন ম্যাডাম ঢুকে গেলেন বলে সে আর ব্যাখ্যা করতে পারল না।
ক্লাস শুরু হওয়ার পর গাত্তু হঠাৎ করে বুঝতে পারল একদিনের জন্যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা বেশি হয়ে গেছে, সত্যি সত্যি যদি রত্না কিংবা ফারিয়া কিংবা মিলি কিংবা আর কেউ স্যার-ম্যাডাম কিংবা প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ করে দেয় তা হলে সে বিপদে পড়ে যাবে।
গাব্বু তখনো জানত না যে সে আসলে বিপদে পড়ে গিয়েছে।
.
০৮.
সকালবেলা গাব্বু ক্লাসরুমে মিলি আর লিটনকে কনভেক্স লেন্স নিয়ে জ্ঞান দান করছিল এবং বিষয়টা হাতে কলমে দেখানোর জন্যে তার বিশাল লেন্সটা জানালার ওপর রেখে তাদের খুঁজতে গিয়েছিল। বাইরে নানা ধরনের উত্তেজনার কারণে তার আর লেন্সটার কথা মনে নেই। ধীরে ধীরে বেলা হয়েছে এবং সূর্যটা উপরে উঠেছে এবং মনে হয় ঠিক গাব্বুকে বিপদে ফেলার জন্যেই বিশাল কনভেক্স লেন্সের ঠিক ফোকাল পয়েন্টে জানালার পর্দাটা বসানো হয়েছে।
রওশন ম্যাডামের ক্লাস যখন মাঝামাঝি পৌঁছেছে ঠিক তখন সূর্যের আলো কনভেক্স লেন্সের কারণে কেন্দ্রীভূত হয়ে জানালার পর্দায় আগুন লাগিয়ে দিল। সস্তা সিনথেটিক কাপড়, কিছু বোঝার আগে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা চিৎকার করতে করতে বের হয়ে আসে, গাব্বু সাথে সাথে বুঝে গেল কী হয়েছে, তাই লেন্সটা না নিয়ে সে বের হতে চাইছিল না, কিন্তু তাকেও ঠেলে বের করা হল। মাঠে সব ছেলেমেয়েরা গাল্লুকে ঘিরে দাঁড়াল, চিৎকার করে বলল, “গাব্বু! তুই এখন কী করেছিস? কী করেছিস বল।”
এরকম একটা আগুন যে গাব্বু ছাড়া আর কেউ লাগাতে পারে না সেটা নিয়ে কারও মনে এতটুকু সন্দেহ ছিল না। গাব্বু আমতা আমতা করতে করতে বলল, “আমার কনভেক্স লেন্সটা জানালার ওপর রেখেছিলাম। মনে হয়, মনে হয়”
সূর্যের আলোকে কেন্দ্রীভূত করে আগুন ধরিয়ে ফেলার মতো তাপ সৃষ্টি করে ফেলা যায় বিজ্ঞানের এত সুন্দর বিষয়টা কারও চোখে পড়ল না। মাঠে সব ছেলেমেয়েরা যখন চেঁচামেচি করছে ঠিক তখন দেখা গেল গাব্বুদের ক্লাসরুমের আগুন নিভিয়ে প্রিন্সিপাল স্যার বের হয়ে আসছেন, ডান হাতে যে জিনিসটা ধরে রেখেছেন গাব্বু দূর থেকেই সেটাকে চিনতে পারল, তার বড় কনভেক্স লেন্সটা, যেটা সে জানালার উপর রেখে এসেছিল।
খাটো প্রিন্সিপাল লম্বা লম্বা পা ফেলে তাদের দিকে এগিয়ে এলেন, লেন্সটা উপরে তুলে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কার?”
এমনভাবে জিজ্ঞেস করলেন যে শুনে মনে হল হাতে যেটা ধরে রেখেছেন সেটা একটা গ্রেনেড কিংবা মেশিনগান কিংবা আধা কেজি পটাশিয়াম সায়নাইড।