তাপস অবাক হয়ে বলল, “কেন? মিলিকে চিমটি দিল কেন?”
রত্না বলল, “ব্যথা দেওয়ার জন্যে।”
তাপস আরও অবাক হল, “ব্যথা দেওয়ার জন্যে? গাব্বু কেন মিলিকে ব্যথা দিচ্ছে?”
গাব্বু বলল, “আমি মোটেও মিলিকে ব্যথা দেই নাই। আমি মিলিকে দেখাচ্ছিলাম নার্ভের ভেতর দিয়ে ব্যথার অনুভূতি যাওয়ার সময় কীভাবে সেটাকে কমানো যায়।”
“কীভাবে?”
“তোর হাতটা দে।”
তাপস তার হাত বাড়িয়ে দিল, গাব্বু সেটা ধরে এক জায়গায় চিমটি দিল। তাপসও”আউ” করে ছোট একটা চিৎকার করল, কিন্তু মিলির মতো লাফঝাঁপ শুরু করে দিল না। গাব্বু তখন তাকে দেখাল কেমন করে ব্যথার ওপর হাত বুলিয়ে ব্যথা কমানো যায়।
তাপসের দেখাদেখি আরও কয়েকজন তখন গাব্বুর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। সবাই যে গাব্বুর কথা বিশ্বাস করল তা না, সেটা নিয়ে গাব্বু অবশ্যি মাথা ঘামাল না। সে অনেকদিন থেকে দেখেছে, বিজ্ঞানের আবিষ্কার সবাই ব্যবহার করে কিন্তু অনেকেই বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করে না। তাদের ক্লাসেই অনেক গাধা আছে যারা ডারউইনের বিবর্তন বিশ্বাস করে না, ভাগ্যিস গাব্বুর গায়ে সেরকম জোর নেই আর সে খুব মারপিট করার মানুষ না, তা না হলে ক্লাসে এই নিয়ে খুনোখুনি হয়ে যেত।
.
আজকের দিনটি অন্যরকম। কারণ ক্লাসরুমের দরজার আড়ালে গাব্বু একটা গগাবদা মাকড়সা পেয়ে গেল, বহুদিন থেকে সে একটা বড় মাকড়সা খুঁজছে। ব্ল্যাক উইডো স্পাইডার নামে এক ধরনের বিষাক্ত মাকড়সা আছে যার কামড় খেলে মানুষ মরে পর্যন্ত যায়, কিন্তু এই দেশের মাকড়সা সেরকম না। মাকড়সার আটটা পা, চোখও অনেকগুলো, বিষয়টা সে এখনো নিজে ভালো করে দেখেনি।
গোবদা মাকড়সাটা একবারও সন্দেহ করেনি যে কেউ তাকে ধরে ফেলবে, তাই সেটা পালানোর চেষ্টা করল না, গাব্বু খপ করে সেটাকে ধরে ফেলল। গাব্বুর হাতের মাঝে মাকড়সাটা কিলবিল করতে লাগল, ছুটে পালানোর চেষ্টা করল, গাব্বু ছাড়ল না। পথে-ঘাটে এরকম মহামূল্যবান জিনিস পেলে সেগুলো রাখার জন্যে তার ব্যাগে নানারকম শিশি বোতল কৌটা থাকে, কাজেই গাব্বু ক্লাসরুমে ঢুকে তার ব্যাগের কাছে গেল। ঠিক তখন তার সাথে রত্নার দেখা হল এবং গাব্বু বুঝতে পারল সে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ পেয়েছে।
রত্না মাকড়সাকে অসম্ভব ভয় পায়। ছোট থেকে ছোট মাকড়সা দেখেও সে ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকে, গাব্বু যে গোবদা মাকড়সাটাকে ধরেছে সেটা দেখলে রত্না নির্ঘাত হার্টফেল করবে। গাব্বু যে মাকড়সাটাকে ধরে রেখেছে রত্না তখনো সেটা দেখেনি। গাব্বু মাকড়সা ধরে রাখা হাতটা পেছনে রেখে জিজ্ঞেস করল, “রত্না, তুই পাইয়ের মান কত পর্যন্ত জানিস?”
“পাই?”
“হ্যাঁ।”
“বেশি না, তিন দশমিক এক চার পর্যন্ত।”
“তুই কি আরও বেশি জানতে চাস?”
রত্না ঠোঁট ওল্টাল, বলল, “আমি কিছু মনে রাখতে পারি না।”
“আমি তোকে দশমিকের পর নয় ঘর পর্যন্ত শিখিয়ে দেব।”
“কীভাবে?”
“তুই শিখতে চাস কি না বল?”
রত্না মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”
গাব্বু তখন মাকড়সা ধরা হাতটা রত্নার সামনে নিয়ে আসে, আর রত্না আতঙ্কে রক্তশীতল করা একটা চিৎকার দিল। রত্নাকে দেখে মনে হল সে বুঝি ভয়ের চোটে মারাই যাবে, পেছনে ছুটে যেতে গিয়ে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
গাব্বু মাকড়সাটাকে রত্নার নাকের সামনে ধরে বলল, “তিন দশমিক এক চার এক পাঁচ নয় দুই ছয় পাঁচ চার।”
রত্না চিৎকার করে ওঠে। গাব্বু ঠাণ্ডা গলায় বলল, “চিৎকার করবি না, আমি কী বলি মন দিয়ে শোন, তিন দশমিক এক চার এক পাঁচ নয় দুই ছয় পাঁচ চার… তিন দশমিক এক চার এক পাঁচ নয় দুই ছয় পাঁচ চার…”
মানুষ যেভাবে মন্ত্র পড়ে গাব্বু সেইভাবে দশমিকের পর নয় ঘর পর্যন্ত পাইয়ের মান উচ্চারণ করতে লাগল। ক্লাসের সবাই কিছুক্ষণ এই বিচিত্র দৃশ্যটি দেখল, তারপর গাব্বুকে টেনে সরিয়ে নিয়ে রত্নাকে উদ্ধার করল।
গাব্বু তার ব্যাগে একটা কৌটার মাঝে আধমরা মাকড়সাটাকে রেখে কৌটার মুখ বন্ধ করল। ফারিয়া মুখ বিকৃত করে জিজ্ঞেস করল, “কী করছিস? এই মাকড়সাটাকে কৌটার মাঝে ঢুকালি কেন?”
“পালব।”
“পালবি? মাকড়সা পালবি?”
“হ্যাঁ।”
“এর মাঝে ছিঃ এর কী আছে?”
“মাকড়সাও একটা পালার জিনিস হল?”
“তুই যদি তোর শরীরে কোটি কোটি ব্যাক্টেরিয়া পালতে পারিস তা হলে আমি একটা মাকড়সা পালাতে পারব না?”
ফারিয়া রেগেমেগে বলল, “আমি কখনো আমার শরীরে ব্যাক্টেরিয়া পালি না।”
“পালিস।”
“পালি না।”
“সবাই পালে। মানুষের শরীরে যতগুলো কোষ তার থেকে অনেক বেশি আছে ব্যাক্টেরিয়া।”
“সত্যি?” ফারিয়া অবাক হয়ে বলল, “আমাদের শরীরে ব্যাক্টেরিয়া থাকে?”
“হ্যাঁ, ভালো ভালো ব্যাক্টেরিয়া আমাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।”
ফারিয়া বলল, “তাই বলে মাকড়সা তো থাকে না–” তারপর মাথা ঝটকা দিয়ে চলে গেল এবং ফারিয়া যখন মাথা ঝটকা দিল তখন গাব্বু দেখল ফারিয়ার মাথায় কত লম্বা চুল। হাইগ্রোমিটার বানানোর জন্যে সে যদি একগোছা এরকম লম্বা চুল পেত কী চমৎকার হত। সে ফারিয়ার পিছু পিছু গেল, “ফারিয়া। ফারিয়া।”
“কী হয়েছে?”
“তোর কী সুন্দর লম্বা চুল।”
ফারিয়া জানে তার সুন্দর লম্বা চুল, মেয়েরা সেটা সবসময় লক্ষ করে, কিন্তু কোনো ছেলে কখনো সেটা লক্ষ করেনি। ফারিয়া অবাক হল যে শেষ পর্যন্ত সেটা একটা ছেলের চোখে পড়েছে এবং কী আশ্চর্য সেই ছেলেটা হচ্ছে গাবু!