গাব্বুকে দেখে লিটন আর মিলি দুজনেই থেমে গেল, কারণ তারা দুজনেই জানে গাব্বু এই আলোচনাটাকে টেনে এত লম্বা করে ফেলবে যে তারা সেখান থেকে আর বের হতে পারবে না। গাব্বু বলল, “তোদের সমস্যাটা কী?”
লিটন তাড়াতাড়ি বলল, “কোনো সমস্যা নাই।”
মিলিও মাথা নাড়ল, “নাই। সমস্যা নাই।” তারপর দুইজনই ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে যেতে শুরু করল।
গাব্বু বলল, “আমি তোদের কথা শুনেছি। উত্তল লেন্স দিয়ে কোনোকিছুকে বড় দেখা যায় না ছোট দেখা যায় সেটা জানতে চাচ্ছিস।”
মিলি বলল, “এখন আর জানতে চাচ্ছি না।” তারপর ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গেল।
গাব্বু পেছন পেছন হেঁটে গিয়ে বলল, “উত্তল লেন্স হচ্ছে কনভেক্স লেন্স। কনভেক্স লেন্স দিয়ে একটা জিনিস বড়ও দেখা যায়, আবার ছোটও দেখা যায়।”
মিলি এবার দাঁড়িয়ে গেল, ভুরু কুঁচকে পেছনে তাকিয়ে বলল, “একটা লেন্স দিয়ে একইসাথে একটা জিনিস বড় আর ছোট কেমন করে দেখা যাবে? আমার সাথে ফাজলেমি করিস?”
“মোটেই ফাজলেমি করছি না। বড় দেখা যায় যদি জিনিসটা ফোকাল লেংথের ভেতরে থাকে। ফোকাল লেংথের বাইরে হলে ছোট হতে পারে।”
মিলিকে লেন্স নিয়ে উৎসাহী হতে দেখা গেল না, সে হেঁটে চলে গেল। লিটন জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ। ক্যামেরায় ছবি তোলে কীভাবে? কনভেক্স লেন্স দিয়ে। আমরা আমাদের চোখে দেখি কেমন করে? কনভেক্স লেন্স দিয়ে।”
লিটন বলল, “ও।”
“টেলিস্কোপের অবজেক্টিভ লেন্স সবসময় কনভেক্স লেন্স দিয়ে তৈরি করতে হয়। আইপিস কনভেক্সও হতে পারে, কনকেভও হতে পারে।”
লিটন বলল, “ও।”
“আইপিস যদি কনভেক্স হয় সেই টেলিস্কোপে সবকিছু উল্টো দেখা যায়।”
লিটন বলল, “ও।”
“আমাদের বাইনোকুলার আমরা সোজা দেখি। তার মানে কী?” গাব্বু লিটনের উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করল না, নিজেই বলে দিল, “তার মানে হচ্ছে বাইনোকুলারের আইপিস হচ্ছে কনকেভ লেন্স।”
লিটন বলল, “ও।” গাব্বু বলল, “আমার ব্যাগে লেন্স আছে। দেখবি?”
লিটন দুর্বলভাবে বলল, “দেখা।”
গাব্বু তখন তার ব্যাগ খুলে সেখান থেকে লেন্স খুঁজে বের করতে থাকে। ব্যাগে শুধু লেন্স নয়, সেখানে দুই ধরনের চুম্বক, কয়েলের তার, কয়েকটা ব্যাটারি, কাঁচের স্লাইড, ক্রু ড্রাইভার, এলইডি, লিটমাস পেপার, ফিল্মের কৌটা, ভিনেগার, শুকনো পোকামাকড়-এরকম অনেক কিছু আছে। গাব্বু যখন লেন্সটা খুঁজে বের করছে তখন লিটন কেটে পড়ার একটা সুযোগ পেল, বলল, “গাব্বু তুই খুঁজে বের কর। আমি আসছি।” তারপর সেও সটকে পড়ল।
গাব্বু শেষ পর্যন্ত তার লেন্সটা খুঁজে পেল, লেন্সটা সে জানালার ওপর দাঁড় করিয়ে লিটনকে খুঁজতে বের হল। সে তখনো জানতো না এই লেন্সটা তার কপালে কত বড় বিপদ ডেকে আনবে।
ক্লাসরুম থেকে বের হয়েই গাব্বু দেখল রবিন মাঠে পড়ে আছে এবং তাকে ঘিরে ছোট একটা ভিড়। রবিন একটু দুষ্টু টাইপের, সারাক্ষণই ছোটাছুটি করছে এবং আছাড় খেয়ে পড়ে ব্যথা পাচ্ছে। কাজেই তার জন্যে এটা মোটেই নতুন ব্যাপার না। গাব্বু কাছে গিয়ে দেখে আসলেই তাই, পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে, নাক-মুখ কুঁচকে যন্ত্রণার শব্দ করছে।
রত্না বলল, “নাক চেপে ধর তা হলে ব্যথা কমে যাবে।”
মিলি বলল, “ঠাণ্ডা পানি খাইয়ে দে।”
লিটন বলল, “গরম সরিষার তেল দিলে ব্যথা কমবে।”
গাব্বু এরকম অবৈজ্ঞানিক কথা শুনে খুবই বিরক্ত হল, কাছে গিয়ে বলল, “ব্যথা কী? ব্যথা হচ্ছে নার্ভ দিয়ে ব্রেনে পাঠানো একটা অনুভূতি। তাই ব্যথা কমানোর একটাই উপায়, সেটা হচ্ছে নার্ভ দিয়ে ব্যথার অনুভূতিটা পাঠাতে বাধা দেওয়া।”
মিলি বলল, “সেটা কীভাবে করা যায়? কক্ষনোই করা যাবে না।”
গাব্বু গম্ভীর হয়ে বলল, “অবশ্যই করা যায়। এই নার্ভ দিয়ে সবরকম অনুভূতি যাচ্ছে। কাজেই পায়ে আরও অনেক রকম অনুভূতি তৈরি করতে হবে যেন সবগুলো পাঠাতে গিয়ে ব্যথার অনুভূতিটা কমে যায়।”
“কীভাবে?”
“হাত বুলাতে থাক। সবচেয়ে সোজা।”
রবিন এমনিতেই হাত বুলাচ্ছিল, এবারে আরও কয়েকজন হাত বুলিয়ে দেয়। গাব্বু গম্ভীর গলায় বলল, “রবিন? ব্যথা কমেছে না?”
রবিন মাথা নাড়ল। গাব্বু রাজ্য জয় করার ভঙ্গি করে বলল, “দেখেছিস?”
মিলি ঠোঁট উল্টে বলল, “কচু।”
গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস করলি না? আয় কাছে আয়। দেখাই।”
মিলি জিজ্ঞেস করল, “কী দেখাবি?”
“তোর হাতটা দে।”
মিলি হাতটা এগিয়ে দেয়, গাব্বু খপ করে হাতটা ধরে সেখানে একটা চিমটি দিল, সাথে সাথে মিলি”আউ আউ” করে চিৎকার করে লাফাতে থাকে। গাব্বু এমন কিছু জোরে চিমটি দেয়নি, কিন্তু মিলি এমন ভাব করতে লাগল যে সে ব্যথায় মরে যাচ্ছে।
গাব্বু বলল, “যেখানে চিমটি দিয়েছি সেখানে হাত বুলা, দেখবি ব্যথা কমে যাবে। নার্ভ দিয়ে–”
মিলি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলল, “কচু। এত জোরে চিমটি দিয়েছিস, এই দেখ লাল হয়ে গেছে–”
গাব্বু দেখল, মোটেও সেরকম লাল হয়নি। মিলির গায়ের রঙ ফর্সা আর ফর্সা গায়ের রঙ হলে অল্পতেই লাল হয়। গাব্বু বলল, “লাল হওয়া মানে বুঝেছিস তো? তার মানে রক্ত জমা হচ্ছে।”
মিলি পা দাপিয়ে বলল, “কচু।” তারপর রেগেমেগে চলে গেল।
তাপস নামে একটা ছেলে পুরো ব্যাপারটা দেখেনি, সে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
লিটন বলল, “গাব্বু মিলিকে চিমটি দিয়েছে।”