মিঠু পাশে বসে থেকে সমান উৎসাহে বলল, “আর আমি।”
গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “কেন? আমি কী করেছি?”
টুনি বলল, “তুই কী করিসনি? সেইদিন তুই একটা এত্ত বড় গোবদা কোলা ব্যাঙ ঘরের ভেতর নিয়ে আসিসনি? বিছানার নিচে তুই গামলা গামলা পচা জিনিস রেখে দিসনি?”
মিঠু সমান উৎসাহে যোগ দিল, “আমার রিমোট কন্ট্রোল গাড়িটা তুমি নষ্ট করে দাওনি? এখন সামনে পিছে যায় না–শুধু এক জায়গায় ঘোরে।”
টুনি টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “আমার মোবাইল ফোনটা তুই নষ্ট করিসনি? ক্যালকুলেটরের বারোটা বাজিয়ে দিসনি?”
গাব্বু হালকা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। টুনি আর মিঠু যে কথাগুলো বলছে সেগুলো সত্যি, কিন্তু সেগুলো কেন অভিযোগ করার মতো বিষয় সেটা সে বুঝতে পারছে না। কয়েকদিন আগে সন্ধেবেলা বাসায় আসার সময় সে দেখে বিশাল একটা কোলা ব্যাঙ লাইটপোস্টের নিচে বসে মহানন্দে লাইটপোস্টের নিচে পড়ে থাকা পোকা খাচ্ছে। গাব্বুকে দেখে সেই কোলা ব্যাঙ লাফ দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু গাব্বু তাকে ধরে ফেলল। বিশাল সেই কোলা ব্যাঙ তার হাত থেকে পিছলে বের হওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু গাব্বু ছাড়ল না, বাসায় নিয়ে এল। ব্যাঙটাকে দেখে টুনি লাফিয়ে নিজের বিছানায় উঠে আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকে। গাব্বু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
“তুই হাত দিয়ে এত বড় ব্যাঙ ধরে রেখেছিস কেন?”
“পালব।”
“পালবি? কোথায় পালবি?”
“কেন, আমার ঘরে।” বলে সে ব্যাঙটাকে ছেড়ে দিল আর ব্যাঙটা ছাড়া পেয়ে কয়েক লাফ দিয়ে বিছানার নিচে ঢুকে গেল।
টুনি চিৎকার করে বলতে লাগল, “এক্ষুনি ব্যাঙটাকে বাইরে ফেলে দিয়ে আয়, বাইরে ছেড়ে দিয়ে আয় বলছি। না হলে তোকে খুন করে ফেলব।”
গাব্বু কিছুতেই বুঝতে পারল না, কেন একটা ব্যাঙের জন্যে তাকে খুন করে ফেলা হবে। সে দুর্বলভাবে চেষ্টা করল, “আপু, ব্যাঙ খুবই শান্তশিষ্ট। এটা বিছানার নিচে থাকবে, পোকামাকড় খাবে। তুমি তো তেলাপোকাকে খুব ঘেন্না কর, এখন এই ঘরে কোনো তেলাপোকা আসতেই পারবে না। আমার ব্যাঙটা খপ করে খেয়ে ফেলবে।”
টুনি বলল, “তেলাপোকা খাওয়ার জন্যে আমার কোনো সাপ-ব্যাঙের দরকার নাই।”
গাব্বু বলল, “আপু, কুনো ব্যাঙের চোখের নিচে বিষাক্ত গ্ল্যান্ড থাকে। এটা কুনো ব্যাঙ না, এটা কোলা ব্যাঙ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন
টুনি চিৎকার করে বলল, “চাই না আমার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ব্যাঙ–”
চেঁচামেচি শুনে আব্বু আম্মু মিঠু সবাই চলে এল, গাব্বু অবাক হয়ে দেখল, বাসায় সবাই টুনির পক্ষে, কেউই তার পক্ষে নেই একটা কোলা ব্যাঙ পোর পক্ষের যুক্তিটা কেউ দেখতে পেল না। গা তখন খুবই মন খারাপ করে বিছানার নিচে গিয়ে ব্যাঙটাকে ধরে আবার লাইটপোস্টের নিচে ছেড়ে দিয়ে এল। সে এখনো বুঝতে পারে না, কেন তার বাসায় আসার পর সাবান দিয়ে গোসল করতে হল।
বিছানার নিচে গামলা গামলা পচা জিনিস রেখে দেওয়ার কথাটা অবশ্যই অতিরঞ্জন। সে মোটেও গামলা গামলা পচা জিনিস রাখেনি, মাত্র দুটো প্লেটে ময়দা দিয়ে তৈরি লেই রেখে দিয়েছিল। একটার মাঝখানে সে একটু থুথু ফেলেছে, অন্যটা পরিষ্কার। তারপর দুটাই প্লাস্টিক দিয়ে ভালো করে ঢেকে বিছানার নিচে রেখে দিয়েছে। মানুষের মুখের মাঝে লক্ষ লক্ষ ব্যাক্টেরিয়া থাকে, তাই থুথুর সাথে সেই ব্যাক্টেরিয়া ময়দার তৈরি লেইয়ের মাঝখানে জায়গা নিয়েছে। আস্তে আস্তে সেই ব্যাক্টেরিয়াগুলো বাচ্চাকাচ্চা দিয়েছে, নাতিপুতি দিয়েছে। সেই নাতিপুতিদের আবার নাতিপুতি হয়েছে। প্লেটের মাঝে ব্যাক্টেরিয়াদের কী বিচিত্র কলোনি! গাব্বু প্রতিদিন মুগ্ধ হয়ে সেগুলো দেখে–সেখান থেকে ধীরে ধীরে একটা পচা গন্ধ বের হতে শুরু করেছে, কিন্তু সেটা তো হওয়ারই কথা। কে শুনেছে ব্যাক্টেরিয়ার কলোনি থেকে মিষ্টি গন্ধ বের হয়?
সপ্তাহখানেক যাওয়ার পর টুনি শুধু নাক কুঁচকে গন্ধ নেয় আর বলে, “ঘরের মাঝে পচা গন্ধ কীসের?” গাব্বু না শোনার ভান করে। শেষে একদিন টুনি খোজা শুরু করল আর সত্যি সত্যি বিছানার নিচে দুটো থালা পেয়ে গেল। একটার মাঝে বিশাল ব্যাক্টেরিয়ার কলোনি, সেখানে কী চমৎকার রঙ, কী বিচিত্রভাবে সেটা বেড়ে উঠছে, অন্যটাতে কী সুন্দর ফাংগাস! গাব্বু অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, টুনি এই অসাধারণ সৌন্দর্যের কিছুই লক্ষ করল না, নাক চেপে ধরে প্রায় বমি করে দেয় সে রকম ভঙ্গি করতে থাকে। চিৎকার করে সে সারা বাসা মাথায় তুলে ফেলল। আব্বু আম্মু এসেও টুনির পক্ষ নিলেন, আর গাবুর এত চমৎকার ব্যাক্টেরিয়া কলোনি টয়লেটে ফ্লাশ করে দেওয়া হল। কী দুঃখের ব্যাপার!
মিঠুর রিমোট কন্ট্রোল গাড়িটা যে এক জায়গায় ঘোরে সেটা সত্যি, কিন্তু এখন সেটাই তো করার কথা। গা প্রথমে গাড়িটা খুলে ভেতরে কী আছে দেখেছে, যে মোটরটা চাকাগুলোকে ঘোরায় সেই মোটরের কানেকশনগুলো উল্টে দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিল গাড়িটার যখন সামনে যাওয়ার কথা তখন পেছনে আর যখন পেছনে যাওয়ার কথা তখন সামনে যায় কি না। যখন গাড়িটার সবগুলো লাগানোর চেষ্টা করল তখন অবাক হয়ে লক্ষ করল তার কাছে দুটা ক্রু বেশি। কী আশ্চর্য–এই দুটা বাড়তি ক্রু কোথা থেকে এসেছে সে বুঝতেই পারল না। গাড়িটা নাড়ালে অবশ্যি ভেতরে কিছু একটা খটর-মটর করে নড়ে, মনে হচ্ছে সেটা ঠিক করে লাগেনি। কাজেই গাব্বু আবার গাড়িটা খুলে ফেলল। পুরোটা ঠিক করে লাগানোর পর এবারে গাব্বু অবাক হয়ে লক্ষ করল এবার তিনটা ক্র বেঁচে গেছে। গাড়িটার ভেতর খটর-মটর শব্দটা নেই, কিন্তু নতুন ইন ইন একধরনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে আবার খুলে ঠিক করে ফেলতে চাইছিল, কিন্তু মিঠু চিৎকার করে বাসা মাথায় তুলে ফেলল। তাই গাব্বু আর ঠিক করতে পারল না, এখন গাড়িটা বাঁকা হয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে। গাব্বুকে যে গাড়িটা ঠিক করতে দেয়নি সেটা তো আর তার দোষ হতে পারে না।