টুনি কেমন যেন চমকে উঠল, গাব্বুর হাত থেকে কার্ডটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে পড়ে একটা আর্তচিৎকার করল।
গাব্বু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
টুনি কথা বলতে পারল না, তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়, নাক দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস বের হতে থাকে। দেখে মনে হয় বুঝি এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে। গাব্বু ভয়ে ভয়ে বলল, “কী হয়েছে আপু?”
টুনি কেমন যেন তোতলাতে তোতলাতে বলল, “তু-তু-তুই বিজ্ঞানী রিফাত হাসানের সাথে কথা বলছিলি? বি-বিজ্ঞানী রি-রি রিফাত হাসান? রিফাত হাসান? রি-রি-রিফাত হাসান?”
গাব্বু থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করল, “রিফাত হাসান কে?”
টুনি কেমন জানি খেপে উঠল, “তুই রিফাত হাসানকে চিনিস না? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক রিফাত হাসান? তিন দিনের জন্যে বাংলাদেশে এসেছেন!”
“ও।”
“কোথায় আছেন এখন?”
“ওই তত বেঞ্চে বসে আছেন!”
টুনি একটা চিৎকার করল, “বসে আছেন? এখনো বসে আছেন? কোথায়?” তারপর গাব্বুর উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে ছুটতে লাগল।
গাব্বু পেছনে পেছনে আসে, টুনি মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোন বেঞ্চে?”
গাব্বু বলল, “ঐ তো ঐ বেঞ্চে ছিলেন।”
“এখন কই?”
“মনে হয় চলে গেছেন।”
“চলে গেছেন?” টুনি হাহাকারের মতো শব্দ করল, “চলে গেছেন?”
গাব্বু বলল, “আমার সাথে আরেকটু কথা বলতে চাচ্ছিলেন, আমি বললাম সময় নাই–”
টুনি কেমন যেন পাগলের মতো হয়ে গেল, গাব্বুকে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “তুই প্রফেসর রিফাত হাসানকে বলেছিস তোর কথা বলার সময় নাই? কথা বলার সময় নাই?”
গাব্বু বলল, “সময় না থাকলে আমি কী করব?”
টুনি দুই চোখ কপালে তুলে গাব্বুর দিকে তাকিয়ে রইল। সে এখনো গাব্বুর কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। টুনি গাব্বুকে ছেড়ে দিয়ে এদিক-সেদিক তাকায়, মাঠের পাশ দিয়ে রাস্তা পর্যন্ত ছুটে যায়, রাস্তার লোকজনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, তারপর হতাশ হয়ে ফিরে আসে।
বাসায় ঢুকেই টুনি চিৎকার করে বলল, “আম্বু আম্মু, তোমরা শুনে যাও, তোমাদের ছেলে কী করেছে।”
আব্বু আম্মু শঙ্কিত মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী করেছে?”
গাব্বুকে তখন পুরো ঘটনাটা খুলে বলতে হল। সবকিছু শুনে আব্বু বললেন, “তুই এত বড় একজন বিজ্ঞানীকে বললি যে তার সাথে কথা বলবি না? অপরিচিত মানুষের সাথে তুই কথা বলিস না?”
গাব্বু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। তুমিই তো সবসময় বল অপরিচিত মানুষের সাথে কথা না বলতে।”
“তাই বলে প্রফেসর রিফাত হাসানের মতো এত বড় একজন বিজ্ঞানীর মুখের উপর সেই কথা বলে দিলি?”
“উনি আমার কথা শুনে কিছু মনে করেন নাই।”
“কেমন করে জানিস?”
“তখন আমাকে কার্ড দিলেন। আমি যখন বললাম, আমি কার্ড বিশ্বাস করি তখন–”
টুনি আর্তনাদ করে উঠল, “উনি তোকে একটা কার্ড দিলেন আর তুই বললি তুই সেই কার্ড বিশ্বাস করিস না?”
“সমস্যাটা কী? তখন স্মার্ট ফোনে ইন্টারনেট দিয়ে তার ওয়েবসাইট দেখালেন, তখন আমি বিশ্বাস করলাম।”
আম্মু বলল, “যখন বিশ্বাস করলি তখন বাসায় নিয়ে এলি না কেন?” গাব্বু বলল, “চিনি না শুনি না রাস্তার একজন মানুষকে বাসায় নিয়ে আসব?”
টুনি গাব্বুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “রাস্তার মানুষ? প্রফেসর রিফাত হাসান রাস্তার মানুষ?”
মিঠু বলল, “ভাইয়া, তুমি প্রফেসর রিফাত হাসানকে চিনতে পারলে না? টেলিভিশনে সবসময় দেখাচ্ছে।”
টুনি বলল, “নামটাও জানিস না? যখন কার্ডটা দিলেন তখন কার্ডের পেছনে একটা অটোগ্রাফ নিতে পারলি না?”
“অটোগ্রাফ?” গাব্বু অবাক হয়ে বলল, “অটোগ্রাফ?”
“হ্যাঁ। চিন্তা করতে পারিস নিজের কার্ডের পেছনে তাঁর অটোগ্রাফ?”
“অটোগ্রাফ দিয়ে কী করব?”
টুনি হাত দিয়ে কপালে একটা থাবা দিয়ে বলল, “গাধাটা বলে অটোগ্রাফ দিয়ে কী করব! যদি শুধু বাসায় নিয়ে আসতে পারতি তা হলে ফটো তুলতে পারতাম। চিন্তা করা যায়? প্রফেসর রিফাত হাসানের সাথে ফটোগ্রাফ?”
মিঠু জিজ্ঞেস করল, “ভাইয়া, উনি তোমার সাথে কী নিয়ে কথা বলেছেন?”
“তুই বুঝবি না। বিজ্ঞানের ব্যাপার-স্যাপার।”
আব্বু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর সাথে বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলেছেন?”
“হ্যাঁ। তোমরা তো আমার কোনো কথাই শুনতে চাও না। উনি সবকিছু শুনেছেন। আমার সব কথা বিশ্বাস করেছেন। টিকটিকির ডাবল লেজের আমার যে থিওরিটা আছে সেইটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছেন।”
টুনি জানতে চাইল, “তুই কেমন করে বুঝতে পারলি?”
“আমাকে বলেছেন।”
“কী বলেছেন?”
“বলেছেন তোমার সাথে বিজ্ঞানের থিওরিটা নিয়ে একটু কথা বলি।”
“আর তুই বলেছিস তোর সময় নাই?”
আম্মু মাথা নেড়ে বললেন, “হায় হায় হায়! এত বড় একজন মানুষ, এত বড় বিজ্ঞানী, তার সাথে তুই এত বড় বেয়াদবি করলি? এই দেশ নিয়ে কী একটা ধারণা নিয়ে ফিরে যাবেন! ভাববেন এই দেশের সব মানুষ বুঝি তোর মতো বোকা। কাণ্ডজ্ঞান নাই।”
আব্বু একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “এত বড় মানুষ, তুই তাকে চিনলি না?”
মিঠু বলল, “আমি পর্যন্ত চিনি।”
টুনি প্রফেসর রিফাত হাসানের কার্ডটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইখানে টেলিফোন নম্বরগুলো আমেরিকার। ইশ! যদি দেশের একটা মোবাইল নম্বর থাকত তা হলে ফোন করতে পারতাম। কোনোভাবে যদি একবার যোগাযোগ করা যেত।”