“ঠিক আছে বিজ্ঞানী গাব্বু। যাও।”
গাব্বু যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেল, বলল, “সবাই যদি আপনার মতো বিজ্ঞানের ব্যাপার-স্যাপার বুঝত, তা হলে কী যে ভালো হত!”
“সবাইকে দোষ দিয়ে আর কী হবে? সবাই তো আর তোমার কিংবা আমার মতো বিজ্ঞান করে না। কেমন করে বুঝবে?”
“আপনি কী নিয়ে গবেষণা করেন সেটা তো বললেন না?”
“আমার গবেষণা মোটেও তোমার মতো ইন্টারেস্টিং না। তোমার তুলনায় খুবই বোরিং। রীতিমতো হাস্যকর।”
গাব্বু উদারভাবে বলল, “তাতে কী আছে! তবু শুনি?”
রিফাত হাসান বললেন, “আমি এক্সেলেটর দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করি। এক্সপেরিমেন্টের পর অনেক ডাটা পাওয়া যায়, সেই ডাটা এনালাইসিস করে একটা পার্টিকেল খুঁজি।”
“কেমন করে খোঁজেন?”
“পার্টিকেলটা থাকলে তার কিছু বৈশিষ্ট্য থাকবে। ডাটাগুলোর মাঝে সেই বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজি।”
গাব্বু বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে বলল, “বুঝেছি।”
গাব্বুর কথা শুনে রিফাত হাসান থতমত খেয়ে গেলেন। তাঁর যে কাজ সেটা গাব্বুর মতো দশ-বারো বছরের বাচ্চার বোঝার কথা নয়। তাই একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বুঝেছ?”
“হ্যাঁ। আসলে আমিও এরকম একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম, একটু অন্যভাবে।”
গাব্বুর কথা শুনে রিফাত হাসান কৌতুক অনুভব করলেন, বললেন, “তুমিও এই রকম এক্সপেরিমেন্ট করেছ?”
“হ্যাঁ। অন্যভাবে।”
“কীভাবে?”
গাব্বু মুখে এক ধরনের গাম্ভীর্য নিয়ে এসে বলল, “আমাদের একজন স্যার আছেন, হাকিম স্যার। খুবই কড়া। সমাজপাঠ পড়ান। পরীক্ষার আগে সবাই চিন্তা করছে স্যার কী রকম প্রশ্ন করবেন। ক্লাসের সবাই স্যারের আগের প্রশ্ন নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে, সেগুলো দেখে আন্দাজ করার চেষ্টা করেছে স্যার এইবার
কী প্রশ্ন করবেন। আর আমি কী করেছি জানেন?”
“কী?”
“আমি করেছি ঠিক তার উল্টো।”
“উল্টো?”
“হ্যাঁ। হাকিম স্যার আগে কী প্রশ্ন করেছেন সেটা দেখার চেষ্টা না করে আমি দেখার চেষ্টা করলাম স্যার আগে কোন কোন প্রশ্ন করেন নাই! শুধু সেইগুলো পড়ে পরীক্ষা দিয়েছি। চোখ বন্ধ করে এ পাস!”
রিফাত হাসান অবাক হয়ে দশ-বারো বছরের এই আধা পাগল ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, বাচ্চাটা ছেলেমানুষি ভঙ্গিতে তার সামনে হঠাৎ একটা আশ্চর্য সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। এক্সপেরিমেন্টাল পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে তার আর তার দলের সবার জীবনের বড় একটা অংশ কাটে এক্সপেরিমেন্টের ডাটা ঘেঁটে। কেমন করে এই ডাটা বিশ্লেষণ করা হবে তার ওপর নির্ভর করে কত তাড়াতাড়ি তারা তাদের এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল প্রকাশ করতে পারেন। এই ছেলেটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে ডাটা বিশ্লেষণের একটা পদ্ধতি বলে দিয়েছে–এত সহজ এত চমৎকার একটা পদ্ধতির কথা তার মাথায় কেন আসেনি রিফাত হাসান সেটা ভেবে অবাক হয়ে গেলেন।
গাব্বু আকাশের দিকে তাকাল, তারপর বলল, “আমি যাই।” রিফাত হাসান বললেন, “দাঁড়াও গাব্বু। এক সেকেন্ড দাঁড়াও।”
গাব্বু মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু দাঁড়ানো যাবে না। আমাদের বাসার নিয়ম হচ্ছে আজান হওয়ার সাথে সাথে বাসায় রওনা দিতে হবে।”
“কিন্তু তোমার জানা দরকার তুমি আমাকে অসাধারণ একটা আইডিয়া দিয়েছ।”
“লাভ নাই।” গাব্বু হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “আমাকে বাসায় যেতেই হবে।”
রিফাত হাসান বললেন, “ডাটাতে একটা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য না খুঁজে আমরা এখন তোমার টেকনিক ব্যবহার করতে পারি। কোনটা নেই সেটা খুঁজতে পারি। অসাধারণ আইডিয়া।”
বিষয়টা নিয়ে গাবুকে খুব উত্তেজিত হতে দেখা গেল না। বলল, “আমার এখন যেতে হবে।”
“এক সেকেন্ড। প্লীজ।”
“উঁহু।” গাব্বু হাঁটতে হাঁটতে বলল, “বাসায় দুশ্চিন্তা করবে।”
রিফাত হাসান ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আমি যদি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে চাই?”
“টেলিপ্যাথি–” গাব্বু গম্ভীর গলায় বলল, “টেলিপ্যাথি করে আমার কাছে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিবেন।”
রিফাত হাসান অবাক হয়ে গাব্বুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
.
০৬.
গাব্বু হেঁটে হেঁটে মাঠটা পার হয়ে ছোট রাস্তাটায় ওঠার পর দেখতে পেল উল্টোদিক দিয়ে টুনি আর মিঠু হেঁটে আসছে। গাব্বুকে দেখে টুনি বলল, “ঠিক আছিস? ঠ্যাং ভাঙে নাই তো?”
গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “ঠ্যাং ভাঙবে কেন?”
মিঠু বলল, “যদি গাছ থেকে লাফ দাও!”
টুনি বলল, “আম্মু আমাদেরকে পাঠিয়েছে তুই গাছপালা থেকে লাফাচ্ছিস কি না সেটা দেখার জন্যে।”
গাব্বু কোনো কথা না বলে হাঁটতে লাগল। টুনি বলল, “এতক্ষণ কী করছিলি?”
“কিছু না।”
“কিছু না মানে?”
“কথা বলছিলাম।”
“কার সাথে কথা বলছিলি?”
“এই তো একজনের সাথে।”
“কী নিয়ে কথা বলছিলি?”
“বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে।”
টুনি বলল, “তুই রাস্তাঘাটের মানুষের সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে কথা বলছিস?”
“মোটেও রাস্তাঘাটের মানুষ না। ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।”
“ইউনিভার্সিটির প্রফেসরদের আর কাজ নাই তোর সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে কথা বলবে।”
গাব্বুর তর্ক করার ইচ্ছা করল না, তাই সে কোনো কথা বলল না। টুনি বলল, “কী নাম ইউনিভার্সিটির প্রফেসরের?”
“ড়িফাট।”
“ড়িফাট? ড়িফাট কারও নাম হতে পারে না।”
গাব্বু বোঝানোর চেষ্টা করল, “আমেরিকানরা ডাকে ড়িফাট। আসল নাম অন্যকিছু।”
“আসল নাম কী?”
“জানি না, ভুলে গেছি।” তখন হঠাৎ করে গাব্বুর মনে পড়ল তার পকেটে একটা কার্ড আছে, বলল, “দাঁড়াও, আমার কাছে একটা কার্ড আছে।” গাব্বু পকেট থেকে কার্ডটা বের করে নামটা পড়ল, “প্রফেসর রিফাত হাসান।”