“অনেক কিছু জানি।”
“কয়েকটা বল দেখি।”
গাব্বু কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “বিজ্ঞানের গবেষণা করার সময় আগে থেকে কাউকে সেটা বলবেন না।”
“কেন?”
“কারণ তারা গবেষণার কিছু বুঝে না, আর সেটা নিয়ে হাসাহাসি করে। আর যদি কাজ না করে তা হলে সারাক্ষণ টিটকারি মারবে। আমি একবার একটা রকেট বানিয়েছিলাম, সেটা কেন জানি উপরে না উঠে নিচে ডাইভ মেরেছিল, তারপর সেটা নিয়ে কী হাসাহাসি কী টিটকারি। দেখা হলেই বলে, এই গাব্বু, তোর রকেটের খবর কী? এখনো মাটির নিচে যায়?”
রিফাত হাসান বললেন, “খুবই অন্যায় কথা।”
গাব্বু হঠাৎ করে ঘুরে রিফাত হাসানকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
“আমি যখন ছোট ছিলাম তখন এখানে থাকতাম। তাই জায়গাটা আবার দেখতে এসেছি, কতটুকু আগের মতো আছে, কতটুকু পাল্টে গেছে।”
“আগের মতোন কী আছে?”
রিফাত হাসান মাথা নাড়লেন, বললেন, “না। মোটেও আগের মতোন নাই। চারিদিকে খালি বিল্ডিং আর বিল্ডিং। এই মাঠটার জন্যে এখনো চিনতে পেরেছি। তুমি যে গাছ থেকে লাফ দিয়েছ, আমিও এই গাছ থেকে লাফ দিতাম।”
“আপনাদের বাসাটা কোথায় ছিল?”
রিফাত সামনে দেখিয়ে বলল, “ঐ যে ছয়তলা দালানটা দেখছ, ওখানে আগে ছোট একটা দুই তলা বিল্ডিং ছিল, আমরা সেইখানে থাকতাম। ডানপাশে একটা টিনের ছাদওয়ালা ছোট বাড়ি ছিল, এখন সেখানে ন-দশ তলা বিল্ডিং! থ্যাংক গড, এই মাঠটা এখনো খালি আছে।”
গাব্বু বলল, “বেশিদিন খালি থাকবে না। এইখানে না কী একটা বারো তলা শপিং কমপ্লেক্স হবে।”
রিফাত হাসান মাথা নেড়ে বললেন, “হাউ স্যাড! কী দুঃখের ব্যাপার।”
গাব্বু হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী নিয়ে গবেষণা করেন?”
“তুমি কী নিয়ে গবেষণা করো?”
“অনেক কিছু। যেমন মনে করেন, টিকটিকির লেজ পড়ে গেলে আরেকটা লেজ গজায়। তা হলে এমন কি হতে পারে আসল লেজটা পড়ার আগেই নতুন একটা লেজ গজালো! তার মানে তখন এক টিকটিকির দুই লেজ!”
রিফাত হাসান হাসলেন, বললেন, “ভেরি ইন্টারেস্টিং।”
“তারপর মনে করেন আমার আরেকটা গবেষণা হচ্ছে টেলিপ্যাথি নিয়ে। আপনি টেলিপ্যাথির নাম শুনেছেন?”
“শুনেছি। একজনের চিন্তা আরেকজনের মাথায় পাঠিয়ে দেওয়া।”
গাব্বুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, এই প্রথম সে একজন মানুষকে পেয়েছে যে নিজে থেকে টেলিপ্যাথি বিষয়টা জানে। এর আগে সবাইকে তার বিষয়টা বোঝাতে হয়েছে এবং কাউকেই সে আসলে বোঝাতে পারেনি এবং সবাই উল্টো তাকে এটা নিয়ে ঠাট্টা করেছে। গাব্বু উত্তেজিত গলায় বলল, “দুইজন যদি অনেকদূরে বসে একই সময় একইভাবে চিন্তা করে তা হলে একজনের চিন্তাটা আরেকজনের মাথায় পাঠানো যায়। চিন্তা করতে হয় এইভাবে-” বলে গাব্বু চোখ বন্ধ করে দুই হাত দিয়ে দুই কান চেপে ধরে ভুরু কুঁচকে গভীরভাবে চিন্তা করার একটা ভঙ্গি করল।
রিফাত হাসান কষ্ট করে হাসি চেপে রেখে মুখে একটা গম্ভীর ভাব ধরে রেখে বললেন, “তুমি কি টেলিপ্যাথি করার চেষ্টা করে দেখেছ যে এটা কাজ করে?”
গাব্বু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কেমন করে পরীক্ষা করব? কাউকে রাজি করাতে পারি না। অনেক কষ্ট করে আপুকে রাজি করিয়েছিলাম। আপু চিন্তা না করে খালি হাসে। হাসলে কেমন করে হবে?”
টেলিপ্যাথি জাতীয় বিষয়গুলো যে আসলে বিজ্ঞানের বিষয় নয়, এগুলো যে বিজ্ঞানের নাম ব্যবহার করে অবৈজ্ঞানিক চিন্তা প্রচার করার একটা চেষ্টা, বিষয়টা গাব্বুকে জানাতে গিয়েও রিফাত হাসান থেমে গেলেন। গাব্বুর এত উত্তেজনার মাঝে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিতে ইচ্ছে করল না, আধপাগল এই বাচ্চাটার মাঝে যদি সত্যিকারের একটা বৈজ্ঞানিক মন থাকে তা হলে সে নিজেই একদিন বিষয়টা বুঝে নেবে।
“এই জন্যে এখনো টেলিপ্যাথির গবেষণাটা শেষ করতে পারি নাই।” গাব্বু বলল, “কেউ টেলিপ্যাথি করতে রাজি হয় না।”
“এত ইন্টারেস্টিং গবেষণা তার পরেও কেউ রাজি হয় না?”
হঠাৎ করে গাব্বুর চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে, রিফাত হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি করবেন?”
রিফাত হাসান চমকে উঠলেন, “আমি?”
“হ্যাঁ। আপনি আর আমি।”
“আ-আ-আমাকে কী করতে হবে?”
“কিছু না, খুবই সোজা। প্রত্যেকদিন ঠিক রাত দশটার সময় আপনি চোখ বন্ধ করে কান চেপে ধরে চিন্তা করে আমাকে কোনো একটা খবর পাঠাবেন।”
“খবর–মানে ম্যাসেজ?”
“হ্যাঁ। আমিও পাঠাব। দেখব ম্যাসেজ যায় কি না।”
“ম্যাসেজটা গিয়েছে কি না সেটা কেমন করে বুঝব?” গাব্বু বলল, “ম্যাসেজটা পেলেই বুঝবেন সেটা গিয়েছে। না বোঝার কী আছে?”
“ও আচ্ছা।”
গাব্বু আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “করবেন এক্সপেরিমেন্ট?”
রিফাত হাসান নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না যখন শুনলেন যে গাল্লুকে বলছেন, “ঠিক আছে!” আমেরিকায় তার ইউনিভার্সিটির বন্ধু-বান্ধব ছাত্রছাত্রী যদি এটা শুনে তা হলে তারা নিশ্চয়ই হাসতে হাসতেই মরে যাবে।
গাব্বু তার সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, “রাত দশটা। প্রত্যেকদিন।”
প্রফেসর হাসান মাথা নাড়লেন, বললেন, “ঠিক আছে। যদি মনে থাকে।”
“আমি আপনাকে মনে করিয়ে দেব।”
“কেমন করে মনে করিয়ে দেবে?”
“কেন? টেলিপ্যাথি দিয়ে!”
রিফাত হাসান বললেন, “ও আচ্ছা! ঠিক আছে। হ্যাঁ মনে করিয়ে দিয়ো।”
ঠিক এরকম সময় দূরের মসজিদ থেকে আজানের শব্দ শোনা যেতে লাগল। গাব্বু তখন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আজান পড়ে গেছে। যেতে হবে।”