রিফাত হাসান গাব্বুর কথা শুনে হেসে ফেললেন, বললেন, “ও আচ্ছা! সেটা অবশ্যি ভালো। অপরিচিত মানুষের সাথে কথা না বলাই ভালো। পৃথিবীতে কতরকম মানুষ আছে, কী বল?”
গাব্বু এবারও কোনো কথা বলল না, উঠে দাঁড়িয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে হেঁটে লোহার বেঞ্চটাতে গিয়ে বসল। রিফাত হাসান জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যথাটা কী একটু কমেছে?”
গাব্বু কথার উত্তর না দিয়ে হাত দিয়ে মুখটা জিপ করে বন্ধ করার মতো ভঙ্গি করল, ভঙ্গিটা খুবই স্পষ্ট, তার মুখ জিপ করে দেওয়া হয়েছে, সে কোনো কথা বলবে না। রিফাত হাসান বললেন, “ও আচ্ছা, মুখ বন্ধ? নো টক।”
গাব্বু মাথা নাড়ল। রিফাত হাসান বেঞ্চের একপাশে বসে বললেন, “আমি যদি আমার পরিচয় দিই, যদি কোনোভাবে প্রমাণ করতে পারি আমি চোর ডাকাত ছেলেধরা না তা হলে কী কথা বলবে?”
“কীভাবে প্রমাণ করবেন?”
রিফাত হাসান পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলেন, সেখান থেকে তার কার্ড বের করে গাব্বুর হাতে দিয়ে বললেন, “এই যে আমার কার্ড। এখানে আমার নাম লেখা আছে। আমার ইউনিভার্সিটির নাম–”
গাব্বু মাথা নেড়ে বলল, “যে কেউ কার্ড বানাতে পারে। আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে পড়ে, তার নাম বল্টু, সেও একটা কার্ড বানিয়েছে, কার্ডে কী লিখেছে জানেন?”
“কী?”
“ফেমাস ফিল্মস্টার।” গাব্বু মুখ গম্ভীর করে বলল, “সেই জন্যে কার্ডকে বিশ্বাস করা ঠিক না। তা ছাড়া—”
“তা ছাড়া কী?”
“এই যে মানিব্যাগটা আপনি বের করলেন, সেটা যে আপনার মানিব্যাগ তার কী প্রমাণ আছে?”
“মানে আমি অন্য কারও মানিব্যাগ নিয়ে এসেছি? পকেটমার?”
“আমি সেটা বলছি না, কিন্তু কোনো প্রমাণ তো নাই।”
রিফাত হাসান এই পাগলাটে ছেলেটার কথা শুনে মজা পেতে শুরু করেছেন। হাসি গোপন করে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ, কোনো প্রমাণ নাই। যদি আজকের পত্রিকাটা থাকত তা হলে অবশ্যি প্রমাণ করতে পারতাম।”
গাব্বু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে?”
“আজকের পত্রিকায় আমার ছবি বের হয়েছে।”
রিফাত হাসানের কথা শুনে গাব্বু একটু সরে গিয়ে বসল। রিফাত হাসান জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল? তুমি একটু সরে গেলে কেন?”
“আপনি বলেছেন পত্রিকায় আপনার ছবি বের হয়েছে। সেই জন্যে। পত্রিকায় সবসময় মার্ডারার আর সন্ত্রাসীর ছবি বের হয়।”
রিফাত হাসান চোখ কপালে তুলে বললেন, “আমাকে দেখে কী মার্ডারার আর সন্ত্রাসী মনে হয়?”
গাব্বু কিছুক্ষণ রিফাত হাসানের দিকে তাকিয়ে রইল, চোখে চশমা, মাথায় আধপাকা চুল, মুখের কোনায় একটু হাসি, ঝকমকে চোখ। বলল, “নাহ্।”
রিফাত বিশাল একটা পরীক্ষায় পাস করেছেন সে রকম ভাব করে বললেন, “থ্যাংকু! তুমি যদি বলতে আমার চেহারা মার্ডারার আর সন্ত্রাসীর মতো তা হলে আমার খুব মন খারাপ হত।”
গাব্বু গম্ভীর গলায় বলল, “চেহারার উপরে মানুষের কোনো হাত নাই।”
“তা ঠিক।”
“আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে সুন্দর চেহারা মিলির। আর মিলি হচ্ছে সারা ক্লাসের মাঝে সবচেয়ে পাজি।”
রিফাত হাসান মাথা নেড়ে বললেন, “ইন্টারেস্টিং।”
গাব্বু কোনো কথা বলল না এবং দুইজন চুপ করে বসে রইল। হঠাৎ রিফাত হাসানের কিছু একটা মনে পড়ল, সোজা হয়ে বসে বললেন, “ইউরেকা।”
গাব্বু রিফাত হাসানের দিকে তাকাল, রিফাত হাসান বললেন, “আমার কাছে একটা স্মার্ট ফোন আছে, সেটা দিয়ে ইন্টারনেট ব্রাউজ করা যায়। উইকিপিডিয়াতে আমার ওপর একটা পেজ আছে, আমি যদি সেখানে গিয়ে আমার পেজটা দেখাই তা হলে কী তুমি বিশ্বাস করবে?”
“ছবি আছে আপনার?”
“মনে হয় আছে।”
রিফাত হাসান পকেট থেকে তার স্মার্ট ফোন বের করে সেটাকে টেপাটেপি করতে লাগলেন এবং কিছুক্ষণের মাঝেই উইকিপিডিয়াতে তার ছবিসহ একটা পেজ চলে এল। রিফাত হাসান দেখালেন, “এই দেখো আমার ছবি। এই দেখো ছবির নিচে আমার নাম, আমি যে ইউনিভার্সিটিতে পড়াই তার নাম। দেখেছ?”
গাব্বু মাথা নাড়ল।
”এখন বিশ্বাস হয়েছে যে আমি ডাকাত কিংবা ছেলেধরা না?”
গাব্বু আবার মাথা নাড়ল।
”এখন আমরা কথা বলতে পারি?”
গাব্বু আবার মাথা নাড়ল, বলল, “পারি।”
রিফাত হাসান গাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমার নাম রিফাত হাসান। আমেরিকার একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। আমেরিকাতে যারা আছে তারা অবশ্যি কেউই আমার নামটা ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারে না। বলে ডিফাট।”
গাব্বু হাত মিলিয়ে বলল, “ড়িফাট?”
হ্যাঁ। ওরা ত উচ্চারণ করতে পারে না। আসলে শুনতেও পারে না। তুমি যদি বল বোতল ওরা শুনতে পায় বোটল।
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। সত্যি বললে ওরা শুনবে সট্যি!”
“কী মজা।”
রিফাত হাসান বললেন, “আমি তো আমার পরিচয় দিলাম, এখন তোমার পরিচয়টা জানতে পারি?”
“আমার নাম গাব্বু। আমার আরেকটা ভালো নাম আছে, সেটা অনেক লম্বা। গাব্বুটাই ভালো, মনে রাখা সোজা।”
“গাব্বু?”
“হ্যাঁ।”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং নেম। তুমি যদি আমেরিকা যাও তা হলে তোমার নামটাও মনে হয় ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারবে না। বলবে ঘ্যাভু।”
“ঘ্যাভু?”
“হ্যাঁ। যাই হোক, এখন তুমি বল তুমি কেন এত উঁচু একটা গাছ থেকে লাফ দিয়েছ।”
“সেটা আপনি বুঝবেন না।”
“বুঝব না?”
“না।”
“কেন?”
গাব্বু মাথা নেড়ে বলল, “এটা হচ্ছে বিজ্ঞানের ব্যাপার। বিজ্ঞান না জানলে এটা বোঝা যায় না। আমি আব্বু, আম্মু, আপু সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কেউ বুঝতে পারে নাই। আপনিও বুঝবেন না।”