“সত্যি? পারবেন?”
“হ্যাঁ। পারব। আমাদের হোটেলের পেছনে একটা সার্ভিস ডোর আছে, আপনি চাইলে আপনাকে আমি সেদিক দিয়ে বের করে দিতে পারি। কেউ জানবেও না, আপনার পিছুও নিতে পারবে না।”
রিফাত হাসানের চোখে-মুখে আনন্দের একটা ছাপ পড়ল। ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে বললেন, “ও! থ্যাংকু থ্যাংকু থ্যাংকু। আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না!”
রিসেপশনিস্ট মেয়েটি বলল, “ধন্যবাদ দিতে হবে না, অন্য একটা কিছু দিলেই হবে।”
“কী?”
“একটা অটোগ্রাফ। আপনি আমাদের হোটেলে উঠেছেন জানার পর থেকে আমার ছোট বোন আপনার একটা অটোগ্রাফের জন্যে আমার মাথা খারাপ করে ফেলছে! প্লীজ একটা অটোগ্রাফ দেবেন?”
রিফাত হাসান বললেন, “একটা কেন? আপনাকে দশটা অটোগ্রাফ দেব–আপনি শুধু আমাকে গোপনে বের হওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দেন!”
রিফাত হাসান যখন এক টুকরো কাগজে একটা অটোগ্রাফ দিচ্ছেন তখন রিসেপশনিস্ট মেয়েটি বলল, “আজকে আমার ছোট বোনের কাছে আমার স্ট্যাটাস কত বেড়ে যাবে আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না!”
রিফাত হাসান কিছু না বলে একটু হাসলেন।
.
একটু পর সত্যি সত্যি রিসেপশনিস্ট মেয়েটি রিফাত হাসানকে বাইরে নিয়ে এল। বড় রাস্তায় এগিয়ে দিয়ে বলল, “এখন আপনি যেতে পারবেন?”
“অবশ্যই পারব।”
“আমার ধারণা খুব বেশি দূর যেতে পারবেন না। পাবলিক আপনাকে হেঁকে ধরবে।”
“ধরবে না। পাবলিক যেহেতু ফুটপাতে রাস্তাঘাটে আমাকে দেখতে আশা করে না তাই আমাকে দেখলেও চিনবে না।”
“না চিনলেই ভালো। গুড লাক।”
রিফাত হাসান মাথা নেড়ে সামনে এগিয়ে গেলেন।
সত্যি সত্যি কেউ তাকে চিনল না। তিনি রাস্তা ধরে হাঁটলেন, দুই পাশের দোকানগুলো দেখলেন। ফুটপাতে বসে থাকা হকারদের দেখলেন, মানুষের ভিড়ের সাথে মিশে রাস্তা পার হলেন, ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক দেখলেন। তারপর একটা স্কুটারের সাথে দরদাম করে তার শৈশবের এলাকাতে রওনা দিলেন।
স্কুটার থেকে নেমে চারিদিকে একবার তাকিয়ে তিনি হকচকিয়ে গেলেন। স্কুটারের ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি আমাকে ঠিক জায়গায় নামিয়েছেন তো?”
ড্রাইভার দাঁত বের করে হাসল, বলল, “জে স্যার। ঠিক জায়গায় নামিয়েছি।”
স্কুটারের ভাড়া মিটিয়ে রিফাত হাসান রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকেন, তার মনে হতে থাকে তিনি যেন সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা জায়গায় হাঁটছেন। এই রাস্তা ধরে বগলে বইয়ের ব্যাগ চেপে ধরে অসংখ্যবার হেঁটে গেছেন, ব্যাপারটা তার বিশ্বাসই হতে চায় না। রাস্তাটা ছেলেবেলায় তার বিশাল মনে হত, এখন মনে হচ্ছে সরু একটা রাস্তা। একটা গলির মোড়ে রিফাত হাসান দাঁড়িয়ে গেলেন, এইখানে একটা ছোট দোকান ছিল, হাতে পয়সা থাকলে এই দোকান থেকে চুইংগাম কিনতেন। সেই দোকানটা নেই, তার বদলে এইখানে একটা শপিং পাজা। কী আশ্চর্য!
রিফাত হাসান আরও কিছুদূর হেঁটে গেলেন, সামনে একটা বিশাল মাঠ ছিল, যদি গিয়ে দেখেন মাঠটা নেই, চৌকোনা চৌকোনা কুৎসিত বিল্ডিং পুরো মাঠ ভরে ফেলেছে তা হলে তার মনে হয় দুঃখে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। রিফাত হাসান ভয়ে ভয়ে হেঁটে সামনে গিয়ে ডানদিকে তাকালেন এবং বুক থেকে একটা শ্বাস বের করে দিলেন। মাঠটা আছে, আগে যে রকম বিশাল তেপান্তরের মাঠের মতো মনে হত এখন সে রকম মনে হচ্ছে না। মাঠটা বেশ ছোট এবং রিফাত হাসানকে স্বীকার করতেই হবে, বেশ নোংরা। অবশ্যি আঠারো বছর পর এ দেশে এসে সবকিছুকেই নোংরা মনে হয় সেটা তিনি মেনেই নিয়েছেন। রিফাত হাসান হেঁটে এগিয়ে গেলেন, মাঠের মাঝখানে একটা গরু ঘাস খাচ্ছে। এক কোনায় বেশ কিছু ছেলে ক্রিকেট খেলছে। রিফাত হাসান মাঠের এক কোনায় দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকালেন, তাদের বাসাটা যেখানে ছিল সেখানে একটা কুৎসিত ছয়তলা ফ্ল্যাট। রিফাত হাসান আস্তে আস্তে মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন, চারিদিকে বড় বড় গাছ ছিল, এখন বেশিরভাগ গাছ নেই। মাঠের মাঝামাঝি গাছটা এখনো আছে। এই গাছটা তার প্রিয় গাছ ছিল। কতদিন এই গাছটার ডাল ধরে ঝপাঝাঁপি করেছেন। আর কী আশ্চর্য, গাছের পাশে লোহার বেঞ্চটাও এখনো আছে, রাত্রিবেলা এই বেঞ্চটাতে শুয়ে শুয়ে তিনি আকাশের তারা দেখতেন।
রিফাত হাসান গাছটার দিকে হেঁটে যেতে থাকলেন এবং তখন লক্ষ করলেন গাছের ডালে দশ-বারো বছরের একটা ছেলে, চোখে চশমা গায়ে লাল রঙের একটা টি-শার্ট। ছেলেটা ডালটাতে উঠে দাঁড়াল এবং তাকে অবাক করে ছেলেটা গাছ থেকে লাফ দিল। এত উঁচু থেকে কেউ সাধারণত লাফ দেয় না।
ছেলেটা নিচে পড়ে নিশ্চয়ই ব্যথা পেয়েছে, কারণ রিফাত হাসান শুনতে পেলেন সে যন্ত্রণার মতো শব্দ করছে। রিফাত হাসান তার কাছে ছুটে গেলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যথা পেয়েছ, ব্যথা পেয়েছ তুমি?”
ছেলেটা উত্তর না দিয়ে আবার যন্ত্রণার মতো শব্দ করল। রিফাত হাসান কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “উঠতে পারবে? ধরব তোমাকে?”
ছেলেটা তখনো কথা বলল না, তার পায়ে যেখানে ব্যথা পেয়েছে সেখানে হাত বুলাতে লাগল। রিফাত হাসান বললেন, “কী হল? কথা বলছ না কেন?”
ছেলেটি পা-টাকে সোজা করার চেষ্টা করতে করতে বলল, “আমি অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলি না।”
ছেলেটি গাব্বু এবং এই বাক্যটি দিয়ে রিফাত হাসানের সাথে তার পরিচয়ের সূত্রপাত হল।