“তখন কী?”
গাব্বু হতাশ হওয়ার মতো করে বলল, “নাহ্, কিছু না।”
“শুনি। বল।”
“রওশন ম্যাডাম এত ভালো ম্যাডাম–সেই ম্যাডামও আমার কথা বিশ্বাস করতে রাজি হলেন না। উল্টো আমাকে গাব্বু আবার কথা শেষ না করে থেমে গেল।
“উল্টো কী?”
“নাহ্, কিছু না।”
“কিছু না মানে? উল্টো তোকে কী?”
“এই উল্টাপাল্টা কথা।”
“কী উল্টাপাল্টা কথা?”
গাব্বুর সেই কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করল না, আবার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা কলা খেতে শুরু করল। আম্মু আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কী উল্টাপাল্টা কথা?”
গাব্বু কলার দিকে তাকিয়ে বলল, “কলার মাঝে পটাশিয়াম থাকে।”
আম্মু বললেন, “তার মানে তুই বলবি না?”
গাব্বু বলল, “কলাগাছকে মানুষ গাছ বলে। আসলে কলাগাছ কিন্তু গাছ।”
আম্মু হাল ছেড়ে দিলেন।
গাব্বু খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার পর আম্মু টুনিকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে স্কুলে? কিছু জানিস?”
টুনি বলল, “কী আর হবে? বাসায় যেটা হয় স্কুলেও নিশ্চয়ই সেটাই হয়েছে।”
মিঠু বলল, “ভাইয়ার এক্সপেরিমেন্ট। সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট।”
আম্মু জানতে চাইলেন, “কী এক্সপেরিমেন্ট?”
মিঠু ঠোঁট উল্টে বলল, “জানি না।”
ঠিক এরকম সময় পাশের ঘর থেকে ধুপ করে একটা শব্দ হল, মনে হল ভারী কিছু একটা নিচে পড়েছে। আম্মু চমকে উঠে বললেন, “কীসের শব্দ?”
টুনি বলল, “কীসের আবার! নিশ্চয়ই তোমার ছেলের কোনো সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট।–”
মিঠু বলল, “আমি দেখে আসি।”
মিঠুর পিছু পিছু টুনি আর আম্মুও গেলেন, গিয়ে দেখলেন গাৱঁ মেঝেতে কয়েকটা বালিশ রেখেছে, তারপর টেবিলের উপর উঠে সেগুলোর উপর লাফিয়ে পড়ছে। আম্মু চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী হচ্ছে, গাব্বু, কী হচ্ছে এখানে?”
“কিছু না”-বলে গাব্বু আবার টেবিলের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ল। আম্মু বললেন, “কিছু না মানে? দেখতে পাচ্ছি তুই লাফাচ্ছিস আর বলছিস কিছু না।”
গাব্বু আবার টেবিলের উপর উঠে লাফ দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে বলল, “বলছি কিছু না। তার কারণ আমি কী করছি সেটা তোমাদের বলে লাভ নাই। তোমরা বুঝবে না।”
টুনি বলল, “বলে দেখ। বুঝতেও তো পারি।”
“সময় নষ্ট করে লাভ নাই। তোমরা বুঝবে না।”
আম্মু বললেন, “আমার বোঝার দরকার নাই। যদি এভাবে বানরের মতো লাফাবি তা হলে বাসার ভেতরে না–বাইরে। আর শুনে রাখ, লাফ দিয়ে যদি ঠ্যাং ভাঙিস তা হলে কিন্তু আমার কাছে আসবি না।”
গাব্বু বলল, “আমার ঠ্যাং পাস্টিকের না যে একটা লাফ দিলেই ভেঙে যাবে।”
“খুব ভালো কথা। কিন্তু লাফালাফি ঘরের ভেতরে না–বাইরে।”
গা টেবিল থেকে লাফ দিয়ে নিচে নেমে বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে, আমি বাইরে যাচ্ছি। তোমাদের যন্ত্রণায় আমি কিছু করতে পারি না। খালি একবার বড় হয়ে নিই তখন দেখি তোমরা আমাকে কীভাবে যন্ত্রণা দাও। আমার যা ইচ্ছা আমি তখন সেটা করব।”
মিঠু জানত চাইল, “বড় হয়ে তুমি কী করবে ভাইয়া? আরও উপর থেকে লাফ দেবে?”
গাব্বু বলল, “তুই সেটা বুঝবি না।”
তারপর পায়ে জুতো পরে সে গম্ভীর মুখে বের হয়ে এল।
.
মোটামুটি এই একই সময়ে রিফাত হাসান হোটেলের লবিতে এসে দাঁড়িয়েছেন, তার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি এগিয়ে এসে বলল, “স্যার, আপনার কী কিছু লাগবে? কোনো সমস্যা।
“সমস্যা তো বটেই!”
“আমরা কী কিছু করতে পারি?”
“মনে হয় না।”
“বলে দেখেন। আমরা কত কী করতে পারি জানলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।”
রিফাত হাসান ঘুরে গেটের দিকে দেখিয়ে বললেন, “ওই গেটে দেখেছেন কতজন সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে?”
রিসেপশনিস্ট মেয়েটা বলল, “দেখেছি। সবাই আপনাকে কাভার করার জন্যে এসেছে। কার আগে আপনাকে নিয়ে কত বড় স্টোরি করতে পারে সেটা নিয়ে প্রতিযোগিতা! এটাকে বলে খ্যাতির বিড়ম্বনা।”
“খ্যাতি থাকলে বিড়ম্বনা সহ্য করার একটা অর্থ আছে। আমাকে কেন? আমি ফিল্মস্টার না, রকস্টার না, ক্রিকেট প্লেয়ারও না! আমাকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন?”
“স্যার, আপনি ফিল্মস্টার, রকস্টার কিংবা ক্রিকেট প্লেয়ার থেকে কোনো অংশ কম না। এই দেশের মানুষ জেনে গেছে আপনি এখানে এসেছেন, তিন দিন দেশে থাকবেন। আপনাকে নিয়ে অনেক কৌতূহল। শুধু আপনার খোঁজে আমাদের হোটেলে এত ফোন এসেছে যে আমাদের পিএবিএক্স ওভারলোড হয়ে যাওয়ার অবস্থা! স্যার, আপনি অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ!”
“আমি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কি না জানি না, কিন্তু সকাল থেকে শুধু গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সাথে কথা বলছি! এখন আমি একটু নিজের মতো থাকতে চাই। হোটেলের গেটে সাংবাদিকেরা বাঘের মতো বসে আছে, বের হওয়ামাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়বে!”
রিসেপশনিস্ট মেয়েটা কী যেন একটা ভাবল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “আপনি কোথায় যেতে চান স্যার?”
“যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের বাসা ছিল গেন্ডারিয়ার দিকে। ভাবছিলাম জায়গাটা একটু দেখব।”
“কাকে নিয়ে যাবেন?”
রিফাত হাসান মাথা নেড়ে বললেন, “কাউকে নিয়ে নয়। একা একা।”
মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, “একা একা? আপনি নিজে?”
রিফাত হাসান বললেন, “এতে অবাক হওয়ার কী আছে?”
“পারবেন?”
“না পারার কী আছে? আমি এই দেশের মানুষ না? আমি এখানে বড় হয়েছি, জীবনের ইম্পরট্যান্ট সময়টা এখানে কাটিয়েছি।”
“ঠিক আছে, আপনি যদি সত্যিই মনে করেন আপনি একা একা ঘুরতে পারেন তা হলে আমি আপনাকে বাইরে বের করার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারি।”