ম্যাডাম মুখ শক্ত করে বললেন, “আমার চেষ্টা করতে হবে না। আমি জানি মানুষ নিজেকে কাতুকুতু দিতে পারে না।”
গাব্বু এবারে বক্তৃতা দেওয়ার মতো করে বলল, “আমরা নিজেকে কাতুকুতু দিলে সবসময় জানি কোথায় কাতুকুতু দেওয়া হবে, সেই জন্যে কাতুকুতু লাগে না। তাই আমি যদি আপনাকে কাতুকুতু দিই আর আপনি যদি আগে থেকে জানেন কোথায় কাতুকুতু দেব তা হলে আপনারও কাতুকুতু পাবে না।”
ম্যাডাম কোনো কথা না বলে একধরনের বিস্ময় নিয়ে গাব্বুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। গাব্বু আবার বক্তৃতার মতো করে বলতে লাগল, “আপনাকে করে দেখাব ম্যাডাম? আপনি আপনার হাতটা আমার হাতের ওপর রাখবেন। আমি সেই হাত দিয়ে আপনাকে কাতুকুতু দেব। আপনি তা হলে আগে থেকে জানবেন আমার হাতটা কোনদিকে যাচ্ছে, কোথায় কাতুকুতু দিচ্ছে। আপনার তা হলে আর কাতুকুতু পাবে না। আমি মিলিকে এইটাই দেখাতে চাচ্ছিলাম, মিলি তখন নালিশ করেছে। আপনাকে করে দেখাব ম্যাডাম?”
ম্যাডামের চোখ কেমন যেন বিস্ফারিত হয়ে গেল, তিনি অবিশ্বাসের গলায় বললেন, “তুমি আ-মা-কে কাতুকুতু দেবে?”
“জি ম্যাডাম, আপনি যদি চান।”
“না, আমি চাই না। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা যদি তাদের স্যার-ম্যাডামদের কাতুকুতু দেওয়া শুরু করে তা হলে তাতে স্কুলের ডিসিপ্লিনের খুব বড় সমস্যা হতে পারে। বাইরে সেই খবর গেলে স্কুলের অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে, বুঝেছ?”
গাব্বু নিশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝেছি।”
ম্যাডাম বললেন, “মনে হয় বোঝো নাই। ক্লাসে তোমার কোনো মনোযোগ নেই। আমি কী পড়াই তুমি সেটা শোনো না। আজব আজব বিষয় নিয়ে কথা বল। ক্লাসে ডিস্টার্ব করো। তুমি খুব বড় সমস্যা।”
গাব্বু অবাক হয়ে বলল, “সমস্যা? আমি?”
ম্যাডাম মুখ শক্ত করে বললেন, “হ্যাঁ, তুমি। আমরা অনেক সহ্য করেছি, আর সহ্য করা হবে না। তুমি যদি ক্লাসের ডিসিপ্লিন নষ্ট করো এখন সেটা প্রিন্সিপালকে রিপোর্ট করা হবে। তোমার বাবা-মাকে জানানো হবে। বুঝেছ?”
গাব্বু নিচু গলায় বলল, “বুঝেছি।”
ম্যাডাম কঠিন গলায় বললেন, “এখন থেকে ক্লাসে আমি আর কোনো থিওরি শুনতে চাই না। চুপ করে ক্লাসে বসে থাকো। মনোযোগটা অন্য কোনোদিকে না দিয়ে আমি কী পড়াচ্ছি সেদিকে দাও, বুঝেছ?”
গাব্বু দুর্বল গলায় বলল, “জি ম্যাডাম, বুঝেছি।”
. স্কুল ছুটির পর যখন টুনি, গাব্বু আর মিঠু বাসায় আসছিল তখন গাব্বুকে কেমন জানি অন্যমনস্ক দেখাতে লাগল। অন্যদিনের মতো সে পিছিয়ে পড়ল না, এদিক সেদিক কোনোকিছু দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়ল না, আজ তার মনটা ভালো নেই। সে কিছুতেই বুঝতে পারল না, চারপাশের মানুষেরা এরকম কেন? কেউ তাকে বুঝতে পারে না কেন?
৫-৬. স্কুল থেকে এসে
স্কুল থেকে এসে তিন ভাইবোন হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে। প্রত্যেকদিনই আম্মু এই সময়টাতে তাদের সাথে স্কুল নিয়ে কথা বলেন। আজকেও শুরু করলেন, “আজকে তোদের স্কুল কেমন হল?”
মিঠু বলল, “খুবই মজার আম্মু, খুবই মজার।”
আম্মু জানতে চাইলেন, “কেন কী হয়েছে?”
মিঠু এক চুমুক দুধ খেয়ে বলল, “আমাদের ক্লাসে একটা নতুন ছেলে ভর্তি হয়েছে। এই মোটা। সে প্রিন্সিপাল স্যারকে ভেবেছে দপ্তরি–” মিঠু কথা শেষ না করে হি হি করে হাসতে থাকে এবং বিষম খেয়ে নাক দিয়ে কয়েক ফোঁটা দুধ বের হয়ে আসে।
গাব্বু গভীর মনোযোগ দিয়ে মিঠুর দিকে তাকিয়ে থাকে। নাকের সাথে গলার যোগাযোগ আছে, আর গলা দিয়ে যাওয়া জিনিস নাক দিয়ে বের হতে পারে–এরকম একটা সম্ভাবনা আছে সে জানত। চোখের সামনে এত বড় একটা বৈজ্ঞানিক ঘটনা দেখেও সে চুপ করে রইল, বিষয়টা অন্যদের ব্যাখ্যা করে বোঝানোর চেষ্টা করল না, তার মনটা খারাপ তাই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
আম্মু বললেন, “প্রিন্সিপাল স্যারকে দপ্তরি ভেবেছে?”
“হ্যাঁ। ভর্তির কাগজ নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসে গিয়েছে, প্রিন্সিপাল স্যার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কী একটা কাজ করছিলেন, মোটা ছেলেটা বলল, এই যে দপ্তরি ভাই, প্রিন্সিপাল স্যার কই?” মিঠু কথা শেষ না করে আবার হি হি করে হাসতে থাকে।
আম্মু বললেন, “অনেক হয়েছে। এখন হাসি বন্ধ করে খা।”
তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোর স্কুল কী রকম হয়েছে?”
টুনি বলল, “প্রত্যেকদিন যে রকম হয় সে রকম।”
আম্মু গাব্বুর দিকে তাকালেন, “তোর?”
গাব্বু একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার জন্যে বাসা যে রকম স্কুলও সে রকম।”
“তার মানে কী?”
“তার মানে হচ্ছে বাসায় তোমরা যে রকম সারাক্ষণ আমাকে জ্বালাও, স্কুলেও সে রকম সবাই আমাকে জ্বালায়।”
“আজকে তোকে কে জ্বালিয়েছে?”
“সবাই।” আম্মু অবাক হয়ে বললেন, “সবাই?”
“হ্যাঁ। লিটন, রত্না, মিলি, রওশন ম্যাডাম, প্রিন্সিপাল স্যার–সবাই।”
“এতজন মানুষ তোকে একসাথে কেমন করে জ্বালালো? তুই কী করছিলি?”
“আমি কিছু করি নাই।”
টুনি বলল, “আম্মু, তুমি গাব্বুর কথা বিশ্বাস কোরো না। নিশ্চয়ই কাউকে দিয়ে সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট করেছে। সেটা করতে গিয়ে কোনো ঝামেলা করেছে।”
“করি নাই।” গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “শুধু–”
“শুধু কী?”
“শুধু কেমন করে কাতুকুতু দিলেও কাতুকুতু লাগবে না সেইটা দেখতে চাচ্ছিলাম, তখন-তখন-”