“কোনো দেশের রানী না স্যার–”
”চাবকে তোমাকে সোজা করে দেব। পিঠের ছাল তুলে দেব।”
“শারীরিক শাস্তি দেওয়া উঠে গেছে স্যার। শারীরিক শাস্তি এখন আইনত বেআইনি। হাইকোর্ট বলেছে–”
প্রিন্সিপাল পারলে তখন তখনই বাঘের মতো গাব্বুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ধারালো দাঁত দুটি দিয়ে গলার রগ ছিঁড়ে ফেলেন, অনেক কষ্ট করে নিজেকে স্থির রেখে দুই হাত দিয়ে গাব্বুর মাথা ধড় থেকে ছিঁড়ে ফেলার ভান করে বললেন, “তোমার এত বড় সাহস? আমাকে তুমি হাইকোর্ট দেখাও? তুমি আমার সাথে টিটকারি মারবে, বলবে একজন রানী খুঁজে বেড়াচ্ছ, আর আমি তোমাকে ছেড়ে দেব? রাজা রানী রাজকন্যা তোমার জন্যে এখানে বসে আছে-মশকরা করার জায়গা পাও না?”
গাব্বু বুঝল যতই সময় যাচ্ছে ততই সে আরো বেশি বিপদের মাঝে পড়ে যাচ্ছে, রানী বলতে সে মোটেও গল্পের রাজা-রানী বলেনি সেইটা পরিষ্কার করতে হবে, তাই গলা উঁচিয়ে বলল, “স্যার, আমি পিঁপড়াদের রানীর কথা বলছিলাম। এই পিঁপড়াগুলো শ্রমিক পিঁপড়া, তাদের একটা রানী আছে, আমি সেই রানীর কথা বলছিলাম।”
প্রিন্সিপাল স্যার হঠাৎ করে বিষয়টা বুঝতে পারলেন। কিন্তু তাতে তার রাগ কমল না। তার চিৎকার শুনে আশেপাশে ছেলেমেয়েদের একটা ভিড় জমে গেছে। তাদের ভেতর থেকে একটা ছোট হাসির আওয়াজ শুরু হয়ে প্রায় সাথে সাথে থেমে গেল। প্রিন্সিপাল স্যারের গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, সেটা রাগে বেগুনি হয়ে গেল। নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা শব্দ করে বললেন, “বেয়াদব ছেলে, তোমাকে আমি সিধে করে ছাড়ব।”
কথা শেষ করে গট গট করে হেঁটে চলে গেলেন। ছেলেমেয়েরা তখন। গাব্বুকে ঘিরে দাঁড়াল, লিটন বলল, “প্রিন্সিপাল স্যার এখন তোকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।”
রত্না বলল, “তুই হচ্ছিস এক নম্বর গাধা।”
গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “কেন? আমি গাধা কেন হব?”
“গাধা না হলে কেউ প্রিন্সিপাল স্যারকে হাইকোর্টের ভয় দেখায়?”
“আমি কি মিথ্যা কথা বলেছি? আসলেই তো হাইকোর্ট রায় দিয়েছে কেউ কোনো ছাত্রকে পেটাতে পারবে না।”
মিলি ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রী, সেই জন্যে অহংকারে মাটিতে তার পা পড়ে না, সে মুখ সুঁচালো করে বলল, “তোর কী দরকার পড়েছিল মাটি খুঁড়ে পিঁপড়ার রানী বের করার? এর থেকে বিজ্ঞান বইয়ের দুই পৃষ্ঠা মুখস্থ করিস না কেন? আমাদের বিজ্ঞান বইয়ে পিঁপড়ার কোনো চ্যাপ্টার পর্যন্ত নাই–”
গাব্বু কী বলবে বুঝতে পারল না। ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সে ভালো করে কখনো বুঝতে পারে না।
.
বাংলা, গণিত আর ইংরেজি ক্লাস পর্যন্ত গাব্বু সহ্য করল, সমাজপাঠ ক্লাস সে আর সহ্য করতে পারল না, তার মনে হল ক্লাস থেকে বের হয়ে স্কুলের বাউন্ডারি ওয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। রওশন ম্যাডাম ক্লাস নিচ্ছেন, তার গলার শব্দ এত একঘেয়ে যে গাব্বুর মনে হতে লাগল যে সে পাগল হয়ে যাবে। কাজেই সময় কাটানোর জন্যে সে তার স্কুলের ব্যাগ থেকে একটা বই বের করল, বইয়ের নাম ”বিজ্ঞানের শত প্রশ্ন”।
গাব্বু সাবধানে বইটা খুলে পড়তে থাকে, এই বইয়ে লেখা বেশির ভাগ জিনিস সে জানে। একটা প্রশ্নের উত্তর ভুল, তবে মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে অংশটা বেশ মজার। কাতুকুতু কেন লাগে, কী করলে কাতুকুতুর অনুভূতি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়–এই অংশটা সে আগে জানতো না। বিষয়টা তখন তখনই সে পরীক্ষা করে দেখল, নিজেকে সে নানাভাবে কাতুকুতু দিতে লাগল এবং সত্যি সত্যি তার কাতুকুতু পেল না। পাশে মিলি বসেছিল, সে ভুরু কুঁচকে গাব্বুর দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কী করছিস?”
গাব্বুও গলা নামিয়ে বলল, “কাতুকুতু দিচ্ছি।”
“কাতুকুতু দিচ্ছিস? কেন?”
“নিজেকে দেওয়া যায় কি না পরীক্ষা করছি। দেওয়া যায় না।”
“নিজেকে মানুষ আবার কেমন করে কাতুকুতু দেবে?”
“দিতে পারে না। অন্যকে পারে। তোকে একটু কাতুকুতু দিই?”
“না।” মিলি চোখ পাকিয়ে বলল, “খবরদার।”
“একটু, প্লীজ।”
“না।”
“প্লীজ!” গাব্বু নরম গলায় বলল, “বেশি দেব না।” বলে সে মিলিকে কাতুকুতু দেওয়ার চেষ্টা করল, আর মিলি তড়াক করে লাফ দিয়ে চিৎকার করে উঠল, “ম্যাডাম! গাব্বু আমাকে জ্বালাচ্ছে।”
ম্যাডাম পড়ানো বন্ধ করে চশমার ওপর দিয়ে গাব্বুর দিকে তাকালেন, রাগী গলায় বললেন, “গাব্বু!”
গাব্বু বলল, “জি ম্যাডাম।”
“কী করছ তুমি?”
“কিছু করছি না।”
মিলি বলল, “করছে ম্যাডাম, আমাকে কাতুকুতু দিচ্ছে।”
মিলির কথা শুনে সারা ক্লাস হেসে উঠল। ম্যাডামের মুখ তখন আরও শক্ত হয়ে উঠল, শীতল গলায় বললেন, “তুমি ক্লাসে একজনকে কাতুকুতু দিচ্ছ? তোমার এত বড় সাহস?”
গাব্বু অপরাধীর মতো বলল, “না ম্যাডাম, আমি আসলে কাতুকুতু দিচ্ছি না, আমি আসলে দেখাচ্ছিলাম কীভাবে কাতুকুতু দিলে কাতুকুতু লাগে না।”
ম্যাডাম চোখ কপালে তুলে বললেন, “তুমি শিখাচ্ছিলে কীভাবে কাতুকুতু দিলে কাতুকুতু লাগে না?”
“জি ম্যাডাম।”
“কীভাবে শুনতে পারি?”
গাব্বু উৎসাহ নিয়ে বলল, “খুব সোজা। এই দেখুন আমি নিজেকে কাতুকুতু দিচ্ছি” বলে গাব্বু নিজেকে নানাভাবে কাতুকুতু দেয় এবং সেই দৃশ্য দেখে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা আনন্দে হাসতে থাকে। গাব্বু তখন কাতুকুতু দেওয়া থামিয়ে বলল, “আমার একটুও কাতুকুতু পায়নি। ম্যাডাম আপনি নিজেকে কাতুকুতু দেওয়ার চেষ্টা করেন, দেখবেন কাতুকুতু পাবে না। দেখেন চেষ্টা করে–”