গাৱঁ দৌড়াদৌড়ি করে খুব বেশি খেলে না, তাই খেলতে যাবে কী না সেটা চিন্তা করছিল, ঠিক তখন স্কুলঘরের দেয়ালে তার চোখ পড়ল। লাল রঙের একটা পিঁপড়ার সারি দেয়াল ধরে এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাচ্ছে। মাঠে ছোটাছুটি করার থেকে এই পিঁপড়ার সারিটা কোথা থেকে শুরু করে কোথায় যাচ্ছে সেটা খুঁজে বের করা তার কাছে অনেক বেশি মজার কাজ মনে হল। তাই সে রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোরা খেল। আমি এখন খেলব না।”
তারপর সে পিপড়ার সারিটা দেখতে শুরু করল। জানালার নিচে দিয়ে সেটা স্কুলঘরের পেছনে গিয়ে মাটির ভেতরে কোথায় জানি ঢুকে গেছে। পিঁপড়ার সারিটা মহাউৎসাহে একটা মরা পোকাকে টেনে আনছে, সেই দৃশ্যটা সে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। পিঁপড়াগুলোর মাঝে একধরনের উত্তেজনা। সামনে যাচ্ছে পেছনে যাচ্ছে, কিছুক্ষণ পোকাটাকে টানছে, অন্য একটি পিঁপড়া এসে ধাক্কা দিয়ে একজনকে সরিয়ে ঢুকে যাচ্ছে, মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে একজন আরেকজনের সাথে কথা বলছে। পিঁপড়ার কথা যদি বুঝতে পারত তা হলে কী মজাই না হত! সে যখন একটা কাঠি দিয়ে পিঁপড়ার সারিটাকে একটু এলোমেলো করে দিয়ে কী হয় দেখছে তখন পেছন থেকে লিটন নামে মোটাসোটা একটি ছেলে জিজ্ঞেস করল, “গাব্বু, কী করছিস?”
গাব্বু বলল, “দেখছি।”
“কী দেখছিস?”
“পিপড়া।”
“পিঁপড়া? তুই আগে কখনো পিঁপড়া দেখিসনি? পিঁপড়া একটা দেখার মতো জিনিস হল?” লিটন হি হি করে দাঁত বের করে হাসল, কাছাকাছি রত্না নামে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে ডেকে বলল, “রত্না, দেখে যা, গাব্বু পিঁপড়া দেখছে।”
ক্লাসের সবারই গাৱঁর কাজকর্ম দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে, আজকাল কেউ আর অবাক হয় না। তাই রত্নাও অবাক হল না, সেও লিটনের মতো হেসে বলল, “মানুষজন যে রকম চিড়িয়াখানায় গিয়ে বাঘ-ভালুক দেখে, গাব্বু সেরকম দেখে পিপড়া।”
লিটন আর রত্নার কথা শুনে গাবুর একটু রাগ হল, সে মুখ শক্ত করে বলল, “তোরা কখনো একটা পিঁপড়াকে ঠিক করে দেখেছিস?”
লিটন বলল, “দেখব না কেন!”
“পিঁপড়ার কয়টা পা, বল দেখি।”
“আট দশটা হবে।”
“উঁহু।” গাব্বু বলল, “ছয়টা।”
“একই কথা।”
“কখনোই একই কথা না–আট পা থাকে মাকড়সার। পিঁপড়ার চোখ কী। রকম বল দেখি।”
“চোখ আবার কী রকম, চোখের মতো।”
“উঁহু। পিঁপড়ার চোখ হচ্ছে কম্পাউন্ড আই। অনেকগুলো ছোট ছোট চোখ মিলে একটা চোখ, বাংলায় বলে পুঞ্জাক্ষী।”
“তোকে বলেছে!”
“পিপড়ার শরীরে কী হাড় আছে?”
“হাড়?” রত্না হেসে বলল, “পিঁপড়ার আবার হাড় থাকবে কেমন করে?”
“আছে।” গাব্বু গম্ভীর হয়ে বলল, “পিঁপড়ার শরীরের খোসাটাই হচ্ছে। হাড়।”
লিটন মুখ বাঁকা করে বলল, “গুলপট্টি।”
“মোটেও গুলপট্টি না। বল দেখি, পিঁপড়া কামড় দিলে ব্যথা লাগে কেন?”
লিটন বলল, “এটা আবার কী রকম প্রশ্ন? কামড় দিলে তো ব্যথা লাগবেই।”
“কামড় দিলে ব্যথা লাগে, তার কারণ পিঁপড়ার কামড়ে আছে ফরমিক অ্যাসিড।”
লিটন মুখ শক্ত করে বলল, “কাঁচকলা।”
কাঁচকলা শুনেও গাব্বু থামল না, বলল, “বল দেখি পিঁপড়া কীভাবে লাইন ধরে যায়?”
“যেভাবে যায় সেভাবে যায়।”
“উঁহু।“
রত্না হি হি করে হেসে বলল, “এক পিঁপড়া আরেক পিঁপড়াকে জিজ্ঞেস করে, ভাই কোনদিকে যাব? তখন সেই পিঁপড়া বলে, এদিকে যাও না হলে ওদিকে যাও। তখন পিঁপড়া এদিক-সেদিক যায়।”
গাব্বু বলল, “মোটেও না। পিঁপড়া যেদিকে যায় সেখানে একটা গন্ধ থাকে। পিঁপড়ারা সেই গন্ধ শুকে এঁকে যায়।
লিটন কাছে এসে নাক কুঁচকে একটু গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করে বলল, “কই আমি তো কোনো গন্ধ পাচ্ছি না।”
গাব্বু বলল, “তুই তো আর পিঁপড়া না। যদি তুই পিঁপড়া হতিস তা হলে ঠিকই গন্ধ পাবি।”
রত্না হেসে গড়িয়ে পড়ল, লিটন হবে পিঁপড়া? লিটনের ওজন কয় কেজি তুই জানিস? একবারে কয়টা হাম বার্গার খায় তুই জানিস? দশটা!”
লিটন রেগে উঠে বলল, “আমি মোটেও একবারে দশটা হাম বার্গার খাই না।”
“খাস।” রত্না বলল, “মিলির জন্মদিনের পার্টিতে আমি নিজের চোখে দেখেছি।”
“মোটেও দশটা খাইনি। ছোট ছোট হাম বার্গার–”
“মোটেও ছোট ছোট না। এতো বড় বড়।”
লিটন আর রত্না হাম বার্গারের সাইজ নিয়ে ঝগড়া করতে করতে অন্যদিকে চলে গেল, গাব্বু তখন আবার পিঁপড়ার সারি দেখতে শুরু করে। মাটির নিচে যেখানে ঢুকে গেছে সেখানে খুঁড়ে দেখতে পারলে হত, পিঁপড়ার রানীটাকে নিশ্চয়ই সেখানে পাওয়া যাবে। সে হাঁটু গেড়ে বসে একটা কাঠি দিয়ে মাঠি খুঁড়তে শুরু করে।
“এই ছেলে, তুমি কী করছ এখানে?” প্রচণ্ড ধমক শুনে গাব্বু পেছন ফিরে তাকাল। তাদের প্রিন্সিপাল কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রিন্সিপালের গলা নেই, ঘাড়ের ওপর সরাসরি মাথা লাগানো, ঠোঁটের ওপর সরু গোঁফ এবং লাল চোখ। চুল মিলিটারিদের মতো ছোট ছোট করে ছাঁটা। তিনি যখন রাগেন তখন মুখের দুই পাশের দুটি দাঁত বের হয়ে আসে, গাব্বু জানে মাংশাসী প্রাণীর মাংস ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে এরকম ধারালো দুটি দাঁত থাকে। এগুলোকে বলে কেনাইন দাঁত।
প্রিন্সিপাল আবার ধমক দিলেন, “কী করছ এখানে?”
“রানী খুঁজছিলাম স্যার।”
প্রিন্সিপাল গাব্বুর কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, চিৎকার করে বললেন, “আমার সাথে ইয়ার্কি করছ? তুমি রানী খুঁজছ? স্কুলে এসেছ রাজকন্যা রানী খোঁজার জন্যে? কোন দেশের রানী তোমার জন্যে এইখানে অপেক্ষা করছে?”