- বইয়ের নামঃ গাব্বু
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১-২. খাবার টেবিলে
খাবার টেবিলে বসে আব্বু এদিক-সেদিক তাকালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “গাব্বু খেতে আসে নাই?”
আব্বুর কথাটা একটা প্রশ্নের মতো শোনালেও এটা আসলে প্রশ্ন না, কারণ দেখাই যাচ্ছে গাব্বু নাই। সে কখনো কোথাও থাকে না। তাকে আনতে হলে প্রথমে ডাকাডাকি করতে হয়, তারপর চেঁচামেচি করতে হয়, সবার শেষে কাউকে গিয়ে তাকে ধরে আনতে হয়। আব্বু ডাকাডাকি শুরু করলেন, “গাব্বু? খেতে আয়।”
গাব্বু কোনো সাড়াশব্দ করল না। তখন আম্মু চিৎকার করলেন, “এই গাব্বু! ডাকছি কথা কানে যায় না?”
এবারেও গাব্বু উত্তর দিল না, উত্তর দেবে সেটা অবশ্যি কেউ আশাও করেনি। টুনি তখন গাব্বুকে ধরে আনার জন্যে উঠে দাঁড়াল তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে গাব্বু নিজেই হাজির হল। সে অবশ্যি এমনি এমনি হাজির হল না, সে হাজির হল ঘুরতে ঘুরতে। দুই হাত দুইদিকে ছড়িয়ে দিয়ে সে সাইক্লোনের মতো ঘুরতে ঘুরতে খাবার টেবিলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
গাব্বুকে এভাবে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে আসতে দেখে কেউই একটুও অবাক হল না, তার কারণ সে সবসময়ই এরকম কিছু না কিছু করছে। তারপরেও আব্বু আর আম্মু অবাক হওয়ার ভান করলেন, আব্বু বললেন, “এটা কী হচ্ছে গাব্বু?”
গাব্বু বলল, “কিছু না।”
আম্মু বললেন, “কিছু না মানে? এভাবে ঘুরছিস কেন?”
গাব্বু কোনো উত্তর দিল না, তখন আম্মু ধমক দিয়ে বললেন, “এভাবে ঘুরলে মাথা ঘুরবে না? থামবি?”
গাব্বু বলল, “এই তো থামছি আম্মু। আর এক সেকেন্ড!”
গাব্বু তখন তখনই থামল না, আরও কিছুক্ষণ পাক খেল। তারপর ঘুরতে ঘুরতে বসার জন্যে এগিয়ে এল। টুনির চেয়ারে ধাক্কা খেল, মিঠুর চেয়ারটা ধরে তাল সামলিয়ে কোনোমতে নিজের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। গাব্বুর মনে হতে থাকে তার সামনে সবকিছু ঘুরছে, তার সাথে সাথে সে নিজেও ঘুরছে। মনে
হতে থাকে সে এক্ষুনি বুঝি উল্টে পড়ে যাবে, তাই সে শক্ত করে টেবিলটা ধরে রাখল যেন তারা পড়ে না যায়। গাব্বু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল, সবাইকে ঝাঁপসা ঝাঁপসা দেখাচ্ছে, আস্তে আস্তে সবাই স্পষ্ট হতে শুরু করল।
সবাই গাব্বুর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল, মাথায় উষ্কখুষ্ক চুল, চোখে বড় ফ্রেমের চশমা, চরকির মতো ঘোরার কারণে মুখে লালচে আভা, নাকের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। আব্বু গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “গাব্বু, এখানে কী হচ্ছে বলবি?”
গাব্বু হাসি হাসি মুখে বলল, “একটা এক্সপেরিমেন্ট করলাম।”
“সেটা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু কীসের এক্সপেরিমেন্ট?”
গাব্বু সবার দিকে তাকাল, তারপর নিশ্বাস ফেলে বলল, “তোমরা মনে হয় বুঝবে না।”
গাব্বুর বয়স মাত্র বারো, কিন্তু এর মাঝেই তার চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সে পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক। সেটি কোনো বড় সমস্যা হওয়ার কথা না, কিন্তু সে যেহেতু প্রতি মুহূর্তেই কোনো না কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করছে এবং তার বেশির ভাগ পরীক্ষার ধকলগুলো বাসার সবাইকে সহ্য করতে হচ্ছে, তাই বাসার সবারই”এক্সপেরিমেন্ট” শব্দটার সাথে একধরনের অ্যালার্জির মতো হয়ে গেছে। তাই যখন গাব্বু তার বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্টের কথা সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে অন্যেরা অনেক সময়ই তার গুরুত্বটা গাবুর মতো করে বুঝতে পারে না।
আব্বু মুখে গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললেন, “চেষ্টা করে দেখ, বুঝতেও তো পারি।”
একটা বৈজ্ঞানিক বিষয় বোঝানোর সুযোগ পেয়ে এবারে গাব্বুর চোখ-মুখ ঝলমল করে ওঠে, সে চোখ বড় বড় করে বলল, “তোমরা সবাই নিশ্চয়ই ভাবো যে, কান দিয়ে আমরা শুধু শুনি। এটা সত্যি না।”
মিঠুর বয়স আট, এই বাসায় শুধু মিঠুই এখনো গাব্বুর বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যে মাঝে মাঝে একটু উৎসাহ ধরে রাখতে পেরেছে। সে চোখ বড় বড় করে বলল, “আমরা কান দিয়ে দেখি?”
“ধুর গাধা! কান দিয়ে আবার দেখব কেমন করে?”
“তা হলে?”
“কানের ভেতরে ছোট ছোট টিউবের মাঝে একরকম তরল পদার্থ আছে। সেটা ব্রেনের মাঝে সিগন্যাল পাঠায়, সেই সিগন্যাল দিয়ে ব্রেন বুঝতে পারে আমি কোথায় আছি, তাই আমরা পড়ে যাই না। সেই জন্যে কেউ যদি ঘোরে তা হলে কানের ভেতরে ছোট ছোট টিউবের মাঝে যে তরল পদার্থ আছে সেটা ওলট পালট হয়ে যায়। তখন আর ব্যালেন্স থাকে না–মাথা ঘোরায়।”
সবাই একধরনের অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে গাব্বুর দিকে তাকিয়ে রইল, গাব্বু বলল, “তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করলে না? ঘুরে দেখো। ঘুরে দেখো আমার মতো।”
আম্মু বললেন, “অনেক হয়েছে। বাসায় একজন পাগল আছে সেইটাই বেশি। এখন সবাই মিলে পাগল হতে হবে না।”
গাব্বু বলল, “পাগল? পাগল কেন হব? তুমি আসো তোমাকে দেখাই আম্মু! খুব সোজা এক্সপেরিমেন্ট।” গাম্বু আম্মুকে ঘোরানোর জন্যে উঠে দাঁড়াল।
আম্মু মাথা নেড়ে বললেন, “ব্যস! অনেক হয়েছে। তোর এক্সপেরিমেন্টের জ্বালায় আমাদের জীবন শেষ।”
টুনি টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “কী বলছ আম্মু তোমাদের জীবন শেষ? তোমাদের জীবন কেন শেষ হবে? জীবন যদি শেষ হয় তা হলে সেটা হচ্ছে আমার!”
টুনি গাব্বু থেকে দুই বছরের বড়। এই বাসায় গাবুর সাথে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হয় টুনির। সে ছিমছাম শান্তশিষ্ট মেয়ে, তার সবকিছু নিয়মমাফিক, সাজানো-গোছানো। গাব্বু হচ্ছে ঠিক তার উল্টো। টুনির সব নিয়মকানুন সাজানো-গোছানো ছিমছাম জীবন গাব্বুর কারণে ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। টুনি বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “গাব্বু কী করে তোমরা তার কিছুই টের পাও না। টের পাই আমি।” বুকে থাবা দিয়ে বলল, “আমি।”