জেবা হাত বাড়িয়ে বলল, “আফা। দুইটা টেহা দিবেন?”
তখন অন্য সবাই হাত বাড়িয়ে দাঁড়াল। ইভা একটা নিশ্বাস ফেলে সবাইকে একটা করে দুই টাকার নোট দিল। টাকা নিয়ে বাচ্চাগুলো উধাও হয়ে যায়, স্টেশনে প্যাসেঞ্জাররা এসেছে এখন তাদের অনেক কাজ।
ঠিক তখন খুব কাছে থেকে কে একজন বলল, “কাজটা ভালো করলেন না।”
গলার স্বর শুনে ইভা চমকে উঠে পাশে তাকাল। সেদিনের লম্বা এবং মাথার চুল উঠে যাওয়া মানুষটা আজকেও স্টেশনে এসেছে। মনে হচ্ছে এই মানুষটাও তার মতো প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাকা যায়। মানুষটা মুখ শক্ত করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভা মানুষটার দিকে তাকাতেই সে মাথা নেড়ে আবার বলল, “কাজটি ভালো করলেন না।”
ইভা উত্তর দেবার চেষ্টা করল না, মাথা নেড়ে মেনে নিল যে কাজটা ভালো হয়নি। গত সপ্তাহে এই মানুষটার কথা শুনে অবাক হয়েছিল আজকে সে খুব বিরক্ত হল। কথার উত্তর না দিলে মানুষটি চলে যাবে ভেবে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু মানুষটি চলে গেল না, বরং আরেকটু কাছে এসে বলল, “এই যে এদের সাথে ভালো করে কথা বলেন এইটা হচ্ছে সবচেয়ে ডেঞ্জারাস।”
ইভা এবারেও কোনো কথা বলল না, অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকাল। এভাবে গায়ে পড়ে কেউ কথা বলতে পারে সে চিন্তাও করতে পারেনি। মানুষটি ইভার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, “আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন এই লোকটা কে। এইভাবে গায়ে পড়ে কথা বলছে কেন! পাগল না কী! আমি আপনাকে রি এশিউর করছি আমি পাগল না। আমার নাম মশিউর রহমান। ডক্টর মশিউর রহমান। আমি এনথ্রোপলজির প্রফেসর, কানাডা থাকি। ছুটিতে দেশে বেড়াতে এসেছি। কাল চলে যাব।”
ইভা এবারে ভালো করে মানুষটার দিকে তাকাল, মানুষটা দেশের বাইরে থাকে তাই এতো সহজে অপরিচিত মানুষের সাথে গায়ে পড়ে কথা বলতে শিখেছে। অপরিচিত একজন মেয়ের সাথেও কোনো সংকোচ ছাড়া কথা বলতে পারে। ইভা মানুষটার দিকে তাকাল তখন এনথ্রোপলজির প্রফেসর মানুষটা বলল, “আপনি জানতে চান না কেন কাজটা ডেঞ্জারাস?”
“কেন?”
“এই বাচ্চাগুলোর সেফটি এন্ড সিকিউরিটির জন্যে। এদের লাইফ স্টাইল আমার আপনার লাইফ স্টাইলের মতো না। এদের লাইফ স্টাইল অনেক কঠিন। এদেরকে এখানে টিকে থাকা শিখতে হয়। প্রতি মুহূর্তে এদের রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। ওদের চারপাশে কোনো বন্ধু নেই–ওদের জন্যে কারো কোনো মমতা নেই।”
ইভা মনে মনে বলল, “আপনারও নেই!” মনে মনে বলেছে বলে এনথ্রোপলজির প্রফেসর কথাটা শুনতে পেল না, তাই সে কথা বলেই চলল, “বেঁচে থাকার জন্যে ওদের নিজেদের মতো করে স্কিল তৈরি করতে হয়। সেখানে কেউ যদি ওদের সাথে ভালো ব্যবহার করে তা হলে ওরা বিভ্রান্ত হয়ে যায়। ওদের সব হিসাব গোলমাল হয়ে যায়। সেই জন্যে আপনি যখন তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করছেন তখন আসলে আপনি তাদের ক্ষতি করছেন।”
ইভা বলল, “আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না।”
ইভার কথা শুনে মানুষটার নিরুৎসাহী হবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না বরং আরো বেশি উৎসাহ নিয়ে সে কথা বলতে শুরু করল। বলল, “বুঝতে পারছেন না? মূল বিষয়টা খুব সহজ। এদেরকে আপনি আপনার নিজেকে দিয়ে বিচার করবেন না। আপনি আপনার চারপাশে যাদেরকে দেখেন তাদেরকে দিয়েও বিচার করবেন না। এরা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এদের মোরালিটি-নৈতিকতা বোধ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপনি আমি যে কাজটি করতে দেখে আঁতকে উঠব এরা অবলীলায় সেটা করে ফেলবে। সারভাইবালস ইন্সটিংট।”
ইভা এতোক্ষণে নতুন করে বিরক্ত হতে শুরু করেছে। যে মানুষের কথা শুনে আগা মাথা বোঝা যায় না তার কথা শোনা থেকে যন্ত্রণা আর কী হতে পারে? ইভা এবারে কানাডাবাসী এনথ্রোপলজির প্রফেসরের সাথে কথাবার্তা শেষ করে ফেলতে চাইল, বলল, “আপনি যা বলছেন সেগুলো নিশ্চয়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা–আমি অবশ্যি তার কিছুই বুঝতে পারি নাই। তাতে কোনো সমস্যা নাই আমি স্টক মার্কেটও বুঝি না ক্রসফায়ারও বুঝি না। অনেক জিনিস না বুঝেই আমি দিন কাটাই। কোনো সমস্যা হয় না। থ্যাংকু।”
ইভা কথা শেষ করে হাঁটতে শুরু করল, ইঙ্গিতটার মাঝে কোনো রকম রাখ ঢাক নাই-তোমার সাথে অনেক কথা হয়েছে এবারে তুমি থাম, আমি গেলাম!
মানুষটা হয় ইঙ্গিতটা বুঝল না, না হয় বোঝার চেষ্টা করল না কিংবা বুঝেও বোঝার ভান করে ইভার পিছনে পিছনে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আপনাকে স্পেসিফিক এক্সাম্পল দেই তা হলে বুঝবেন। মনে করেন–”
ইভা না শোনার ভান করে হেঁটে যেতে থাকে, মানুষটা তখন হেঁটে তার সামনে এসে বলল, “মনে করেন এই বাচ্চাগুলোর একজন এসে আপনার কাছে দুই টাকা চাইল। আপনি বললেন আমার কাছে ভাংতি দুই টাকা নেই। একটা দশ টাকার নোট আছে তুমি টাকাটা ভাঙিয়ে এনে দাও। তারপর আপনি বাচ্চাটাকে দশ টাকার নোটটা দেন–দেখবেন বাচ্চাটা দশ টাকার নোট নিয়ে ভেগে যাবে।”
ইভা এই প্রথম মানুষটার একটা কথা বুঝতে পারল। মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার তাই ধারণা?
“হ্যাঁ। ধারণা না এটা হচ্ছে সত্য। টুথ ওয়ে অফ লাইফ। আপনি মনে করবেন না সেই জন্যে আমি এই বাচ্চাটাকে দোষী বলব। আমি-”
ইভা মানুষটাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন আমি যদি একটা ছোট বাচ্চাকে দশ টাকার একটা নোট দিয়ে ভাংতি করে আনতে বলি সে টাকাটা নিয়ে পালিয়ে যাবে?”