.
জালাল আর কুক্কু যখন হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে তখন ছেলেমেয়েদের স্কুল ছুটি হওয়ার সময়। কাছাকাছি নিশ্চয়ই কোনো একটা স্কুল আছে সেই স্কুল থেকে সব ছেলেমেয়েরা বের হয়েছে। বড়লোকের বাচ্চারা গাড়ি চেপে হুশ হাশ করে বের হয়ে যাচ্ছে। সাবধানী মায়েরা নিজেরা এসে বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক বাচ্চা রিকশা ভ্যানে চেঁচামেচি করতে করতে যাচ্ছে। যেসব ছেলেমেয়েদের বাসা কাছাকাছি কিংবা রিকশা করে বাসায় যাবার টাকা নেই তারা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। দেখেই বোঝা যায় কোন বাচ্চাগুলো বড়লোকের ছেলেমেয়ে আর কোন বাচ্চাগুলোর বাবা-মা গরিব টাইপ। বড়লোকের বাচ্চাগুলো কেমন জানি ঢিলেঢালা নাদুস নুদুস। গরিব টাইপের বাচ্চারা শুকনো আর টিংটিংয়ে–অনেকটা জালালের মতো।
যে বাচ্চাগুলো স্কুল শেষ করে বাসায় ফিরে যাচ্ছে তাদের অনেকেই জালালের বয়সি। এই বাচ্চাগুলো স্কুলে যেতে পারছে আর জালাল স্কুলে যেতে পারছে না, সেই জন্যে তার মোটেও হিংসা হয় না, বরং খানিকটা আনন্দ হয়। দরজা-জানালা বন্ধ একটা ঘরের ভেতরে মাস্টারেরা ধরে ধরে তাকে পেটাবে আর সেই পিটুনি মুখ বন্ধ করে সহ্য করতে হবে এর কোনো অর্থ হয় না। তার তো আর বড় হয়ে জজ-ব্যারিস্টার হওয়ার ইচ্ছা নাই তা হলে খামোখা স্কুলে গিয়ে কষ্ট করবে কেন? ছোট থাকতে যখন নিজের গ্রামে ছিল তখন এক দুই বছর স্কুলে গিয়েছিল। স্কুলের স্যারদের ধুম পিটুনি খেয়ে বানান করে একটু একটু পড়তে পারে। টাকা-পয়সা গুনতে গুনতে যোগ-বিয়োগ খুব ভালো শিখে গেছে, এর থেকে বেশি তার জানার দরকার নেই, জানার কোনো ইচ্ছাও নেই।
মহাজন পট্টিতে গিয়ে জালাল একটা গলির ভেতর ঢুকে গেল। গলির শেষের দিকে পুরানো একটা বিল্ডিং, সেই বিল্ডিংয়ের দরজায় সে ধাক্কা দিল।
ভেতর থেকে ভারি গলায় একজন জিজ্ঞেস করল, “কে?”
জালাল বলল, “আমি ওস্তাদ। জালাল।”
“ও।” একটু পরেই দরজাটা খুট করে খুলে গেল, দরজার সামনে শুকনো একজন মানুষ জালালের দিকে তাকিয়ে বলল, “আয় জাল্লাল।”
শুকনো এই মানুষটির নাম জগলুল, জালাল তাকে ওস্তাদ ডাকে, আর এই মানুষটি জালালকে কেন জানি জাল্লাল বলে ডাকে!
জালাল কুক্কুকে বাইরে বসিয়ে রেখে তার পলিথিনের ব্যাগ বোঝাই প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে ভেতরে ঢুকল। জগলুল নামের মানুষটা–জালাল যাকে ওস্তাদ ডাকে, সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিল। ভেতরে আবছা অন্ধকার, চোখটা সয়ে যেতেই একটু পরে ওস্তাদের ফ্যাক্টরিটা দেখা গেল। এই ফ্যাক্টরির মালিক ম্যানেজার শ্রমিক সবকিছুই ওস্তাদ একা! জালালের ওস্তাদ কামেল মানুষ। তার ফ্যাক্টরিতে অনেক কিছু তৈরি হয়–এখন ওস্তাদ প্লাস্টিকের খালি বোতলে পানি ভরে তার মুখটা সত্যিকারের ফ্যাক্টরির কায়দায় সিল করছে যেন সেগুলো সত্যিকারের পানির বোতল হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়। ওস্তাদের এক পাশে সারি সারি খালি পাস্টিকের বোতল। সামনে একটা বড় বালতিতে পানি। বালতির কিনারে একটা লাল রঙের প্লাস্টিকের মগ। ওস্তাদ মগে করে বালতি থেকে পানি নিয়ে প্রাস্টিকের খালি বোতলে ভরে ভরে এক পাশে রাখতে লাগল। জালাল পলিথিনের ব্যাগে করে আনা তার খালি প্লাস্টিকের বোতলগুলো নিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে।
ওস্তাদ বেশ অনেকগুলো বোতলে পানি ভরে ছিপিগুলো জুড়ে দেওয়ার কাজ শুরু করে। একপাশে ইলেকট্রনিক্সের কাজ করার একটা সল্ডারিং আয়রন গরম হচ্ছিল। ওস্তাদ সেটা হাতে নিয়ে খুব সাবধানে পানির বোতলের ছিপিটা একটু গলিয়ে আলগা রিংটার সাথে জুড়ে দিতে লাগল। ওস্তাদের হাতের কাজ খুবই ভালো, খুব ভালো করে তাকিয়েও কেউ বুঝতে পারবে না এটা আলাদাভাবে জুড়ে দেওয়া আছে। খোলার সময় সিলটা ভেঙে খুলতে হবে কাজেই মনে হবে বুঝি একেবারে ফ্যাক্টরি থেকে আসা বোতল। ছিপিটা লাগানোর পর তার উপরে স্বচ্ছ পাস্টিকের ছোট একটা টিউব ঢুকিয়ে সল্ডারিং আয়রনের জোড়া দিয়ে একটু সেঁক দিয়ে সেটাকেও ভালো করে লাগিয়ে নেয়। কাজ শেষ হবার পর ওস্তাদ পানির বোতলটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে মুখে একটা সন্তুষ্টির মতো শব্দ করল।
জালাল মুগ্ধ চোখে ওস্তাদের কাজ দেখছিল, বলল, “ফাস্ট ক্লাশ! আসল বুতল থাইকা ভালা।”
ওস্তাদ মাথা নেড়ে বুকে থাবা দিয়ে বলল, “জগলুল ওস্তাদের হাতের কাজে কোনো খুত নাই।”
“না ওস্তাদ। কুনো খুত নাই।”
“চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়িস ধরা।”
জালাল আপত্তি করল, “জে না ওস্তাদ। এইটা তো চুরি না। এইটা তো ফ্যাক্টরি। এইখানে তো কেউ চুরি করে না ওস্তাদ। এইখানে কারো কুনু ক্ষতি হয় নাই।”
ওস্তাদ মাথা নাড়ল, বলল, “তা ঠিক। আমি তো বোতলে ময়লা পানি দেই না। টিউবওয়েলের পরিষ্কার পানি দেই। খাঁটি পানি।” ওস্তাদ আরেকটা বোতল রেডি করতে করতে বলল, “কিন্তুক পুলিশ-দারোগা টের পেলে খবর আছে।”
“টের পাবি না ওস্তাদ। কুনুভাবে টের পাবি না।”
“না পাইলেই ভালো। তুই খবরদার কাউরে বলবি না।”
“কী বলেন ওস্তাদ! আমি কারে বলমু? কুনুদিন বলমু না।”
বেশ কিছুক্ষণ কাজ করে জগলুল ওস্তাদ একটু বিশ্রাম নেয়। খুব যত্ন করে একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে উপর দিকে ধোয়া ছাড়ল। জালাল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, তারও মনে হয় সিগারেট খাওয়াটা শিখতে হবে। তা হলে সেও এইরকম সুন্দর করে আকাশের দিকে ধোঁয়া ছাড়তে পারবে। তবে কাজটা সোজা না। একদিন চেষ্টা করে দেখেছে কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা।