খসখসে গলার মানুষটা একটু নিশ্বাস ফেলে বলল, “এর অর্থটা কী বুঝেছেন ড্রাইভার সাহেব?”
“কী?”
“এর অর্থ এর মাঝে পুলিশ র্যাব বর্ডার গার্ড সব জায়গায় খবর চলে গেছে। এর অর্থ পুলিশ র্যাব বর্ডার গার্ড আপনাকে আর আপনার বসকে খুঁজতে শুরু করেছে। আপনাদের মতো কাঁচা কাজ যারা করে তারা ধরা পড়ে জেলখানার ভাত খেলে আমার কিছু বলার নাই। কিন্তু আপনাদের কাঁচা কাজের জন্যে আমার সমস্যা হলে আমার খুব মেজাজ খারাপ হয়।”
কাদের ড্রাইভার বলল, “কিন্তু কিন্তু–”
খসখসে গলার মানুষটার গলা আরও খসখসে হয়ে গেল। বলল, “আমি মানুষটা হাসিখুশি–আমার সহজে মেজাজ খারাপ হয় না। আজকে মেজাজ খারাপ হল। শেষবার যখন আমার মেজাজ খারাপ হয়েছিল তখন এক ডজন লাশ পড়ছিল। এইবার তার থেকে বেশি পড়তে পারে–”
কাদের ড্রাইভার আবার কথা বলার চেষ্টা করল কিন্তু তার গলা থেকে কোনো শব্দ বের হল না। ফ্যাকাসে মুখে দেখল খসখসে গলার স্বরের মানুষটা হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে।
.
ইভা ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কিছু একটা পড়ে। এটা তার বহুদিনের অভ্যাস। আজকেও সে একটা বই পড়ছিল, নতুন একজন লেখকের উপন্যাস, পড়া শেষ করে শুয়ে পড়বে করতে করতেই বেশ রাত হয়ে গেল। যখন প্রায় জোর করে বইটা বন্ধ করে বালিশে মাথা রাখল ঠিক তখন তার টেলিফোনটা বেজে উঠল।
এতো রাতে কে ফোন করতে পারে ভেবে সে টেলিফোনটা টেনে নেয়, অপরিচিত একটা নম্বর। ফোনটা ধরবে কী ধরবে না ভাবতে ভাবতে সে টেলিফোনটা ধরল, “হ্যালো।”
“দুই টেকি আপা?”
ইভা চমকে উঠল–তাকে দুই টেকি আপা ডাকে স্টেশনের বাচ্চারা। এতে রাতে স্টেশনের একটা বাচ্চা তাকে কেন ফোন করবে? ইভা বিছানায় সোজা হয়ে বসল, বলল, “তুমি কে?”
“আপা, আমি জালাল।”
“জালাল? তুমি এতো রাতে?”
“আপা, আমাদের অনেক বড় বিপদ হইছে।”
“কী বিপদ?”
“আপা ছেলেধরা আমাগো বিশজনকে ধইরা ইন্ডিয়া পাঠাইতে লাগছিল–”
ইভা চমকে উঠল, “কী বলছ তুমি?”
“সত্যি বলছি আপা। আমরা অনেক কষ্ট কইরা পালাইয়া আইছি।”
ইভা বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে বলল, “থ্যাংক গড। এখন তোমরা কোথায়?”
“সবাই একটা খেতের মাঝে লুকাইয়া আছি-আমি একটা দুকান থাইকা আপনেরে ফোন করতে আসছি।”
“তোমরা পুলিশের কাছে যাও না কেন? থানাটা খুঁজে বের করে এক্ষুনি পুলিশের কাছে যাও।”
জালাল টেলিফোনের অন্যপাশে চুপ করে রইল। ইভা বলল, “কী হল?”
“আপা”
“বল।”
“পুলিশের কাছে গিয়া আমাগো কোনো লাভ নাই। আমাগো কেউ বিশ্বাস করে না। দূর দূর কইরা দৌড়াইয়া দেয়। আর ছেলেধরার লগে পুলিশের মনে হয় খাতির আছে। আমাগো যদি আবার ছেলেধরার কাছে ফেরত দেয়?”
“কী বলছ তুমি?”
“সত্যি কথা কইতাছি আপা। আমরা গরিব মানুষ, রাস্তার পোলাপান আমাগো কোনো কথা কেউ বিশ্বাস করে না। মনে করেন এই যে ফোন করতাছি–”
“হ্যাঁ, কী হয়েছে ফোনের?”
“কেউ আমাগো একটা ফোন পর্যন্ত করতে দেয় না। দূর দূর কইরা দৌড়ায়া দেয়। অনেক কষ্ট কইরা ফোন করতাছি”
“ঠিক আছে জালাল, তোমরা এখন কোথায়?”
“জানি না আপা। মনে লয় বর্ডারের কাছে।”
“তুমি যার ফোন থেকে কল করেছ তাকে দাও দেখি–”
“দেই আপা।”
ইভা তখন সেই মানুষটার সাথে কথা বলল, জায়গাটা কোথায় সেটা কোন থানায় পড়েছে এই বিষয়গুলো জেনে নিল। তারপর আবার জালালের সাথে কথা বলল। জালালকে বলল, “তোমার কোনো চিন্তা নেই। তোমরা যেখানে আছ সেখানে ঘাপটি মেরে বসে থাক। আমি সব ব্যবস্থা করছি।”
“কী ব্যবস্থা করবেন আপা?”
“পুলিশ র্যাব যেটা দরকার সেটা পাঠাব।”
“আমাগো কুনো সমিস্যা হবি না তো?”
“না। তোমাদের কোনো সমস্যা হবে না। এমনিতে তোমরা ভালো আছো তো?”
জালাল বলল, “জে আপা।”
“কেউ ব্যথা পায় নাই তো?”
“আমি একটু পাইছি।”
“সর্বনাশ! কেমন করে–”
“ট্রাক থেকে লাফ দিছিলাম–একটুর জন্যে ট্রাকের নিচে পড়ছিলাম।”
ইভা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। বাচ্চা পাচারকারীর হাতে ধরা পড়ল কেমন করে, ছাড়াই বা পেল কেমন করে কে জানে। সে এখন আর সেটা জানতে চাইল না, জালালকে বলল, “তুমি অন্যদের সাথে গিয়ে বস। আমি ব্যবস্থা করছি।”
ঠিক আছে আপা। তারপরে লাইন কেটে গেল।
জালাল যখন হেঁটে হেঁটে অন্য সবার কাছে ফিরে যাচ্ছে ইভা তখন টেলিফোনে নানা মানুষের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে।
ইভার যোগাযোগ খুব ভালো, ভোর হওয়ার আগেই জালাল আর সব বাচ্চা কাচ্চাকে উদ্ধার করা হল, কাদের ড্রাইভার আর মাজহারসহ ট্রাকটাকে আটক করা হল। তারা খুব অবাক না হলেও জরিনি খালা আর মন্তাজ মিয়াকে যখন ধরা হল তারা একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। পরদিন পত্রিকায় বিশটি বাচ্চা এবং পিছনে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় জরিনি খালা, মন্তাজ মিয়া, কাদের ড্রাইভার আর মাজহারের ছবি ছাপা হল। বাচ্চারা সবাই খবরের কাগজে ছাপা হওয়া সেই ছবিটা দেখেছিল, টেলিভিশনে তাদের যে সাক্ষাৎকারটা প্রচারিত হয়েছিল সেটা অবশ্যি তারা কেউ দেখতে পায়নি। তারা দেখার জন্যে টেলিভিশন কোথায় পাবে?
১৩. ছলছল চোখে
মায়া ছলছল চোখে ইভাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি বিষ্যুৎবার কইরা আর আইবা না আফা?”
ইভা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল, তারপর বলল, “না, মায়া। আমি বিষ্যুৎবার করে আর আসব না। আমাকে ঢাকাতে ট্রান্সফার করেছে।”