জালাল বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিল তারপর একটা ঝটকা দিয়ে লাফ দিল, চেষ্টা করল রাস্তায় পড়ার সাথে সাথে গড়িয়ে সরে যেতে। প্রচণ্ড জোরে সে রাস্তার মাঝে আছাড় খেয়ে পড়ে, মাথার এক আঙুল কাছ দিয়ে ট্রাকের চাকাগুলো পার হয়ে গেল, তার মাঝে জালাল গড়াতে গড়াতে রাস্তার কিনারে একটা গাছের সাথে। ধাক্কা খেয়ে থামল। জালালের মনে হল সে নিশ্চয়ই মরে গেছে। কয়েক সেকেন্ড পর বুঝতে পারল সে মরেনি, তখন মনে হল সে নিশ্চয়ই মরে যাবে। আরো কয়েক সেকেন্ড পরে দেখল সে মরেনি এবং তখন প্রথমবার তার মনে হতে লাগল সে হয়তো এবারে বেঁচে যাবে। জালাল মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে তার হাত-পা নিশ্চয়ই ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেছে। সে সাবধানে তার হাত নাড়ল, পা নাড়ল এবং তখন সে বুঝতে পারল অনেক ব্যথা পেলেও আসলে তার হাত-পা ভাঙেনি শুধু শরীরের ছাল-চামড়া উঠে গেছে।
ঠিক তখন সে অনেকগুলো ছোট ছোট পায়ের শব্দ শুনতে পেল এবং দেখতে দেখতে সবগুলো বাচ্চা তাকে ঘিরে দাঁড়াল। কে একজন তার উপর ঝুঁকে পড়ে ভাঙা গলায় ডাকল, “জালাল, এই জালাল–”
জালাল গলার স্বর শুনে চিনতে পারল, জেবা তাকে ডাকছে।
কে একজন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, “মরে গেছে–মরে গেছে-”
জেবাও এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, “জালাল–এই জালাইল্যা তুই মরিস না–আল্লাহর কসম লাগে।”
জালাল উঠে বসার চেষ্টা করে বলল, “মরি নাই। আমি মরি নাই।”
“মরে নাই–মরে নাই–” সবাই মিলে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “জালাল মরে নাই।”
কয়েকটা গাড়ি চলে যাবার পর জালাল জেবার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রাস্তা থেকে নিচে নেমে আসে, অন্য সবাই তখন সেখানে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে। হঠাৎ করে সবার মন ভালো হয়ে গেছে, ফিসফিস করে নিজেদের ভেতর কথা বলছে, খিক খিক করে হাসছে, হাসতে হাসতে একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিচ্ছে, ধাক্কা দিয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। এরা চব্বিশ ঘণ্টা আগেও কেউ কাউকে চিনত না, এখন এরা সবাই একে অন্যের প্রাণের বন্ধু।
জালাল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমাগো মনে হয় এইখানে থাকন ঠিক না।”
জেবা জানতে চাইল, “ক্যান?”
“হেরা যখন দেখব ট্রাকের ভেতরে কেউ নাই তখন আমাগো খুঁজতে আসব না?”
জালালের বয়সী একটা ছেলে বলল, “আইতে দাও। আমি যদি কল্লাটা না ছিঁড়ি।”
সবাই হইহই করে উঠল, “কল্লা ছিড়া ফালামু। কল্লা ছিড়া ফালামু।”
কারো ভেতরে কোনো ভয়ডর নেই এবং তাদেরকে দেখে জালালের ভেতরের ভয়ডরও আস্তে আস্তে উঠে যেতে শুরু করল।
.
কাদের ড্রাইভার তার ট্রাকটাকে রাস্তার পাশে দাঁড়া করাল। অন্ধকারে একজন মানুষ দাঁড়িয়েছিল সে তার টর্চ লাইটটা কয়েকবার জ্বালাল আর নিভাল। তারপর ট্রাকটার দিকে এগিয়ে এল।
কাদের ড্রাইভার ট্রাকের জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলল, “ভাইয়ের নাম কী?”
“মিজান।”
“মিজান বকশ?”
“হ্যাঁ।”
“উঠেন।”
মাজহার দরজা খুলে একটু সরে মিজান বকশকে বসার জায়গা করে দিল। মিজান বকশ মাজহারের পাশে বসে বলল, “চলেন। আমাদের বস মাল ডেলিভারি নেবার জন্যে বসে আছেন।”
কাদের ড্রাইভার তার ট্রাক স্টার্ট করল, মিজান বকশ বলল, “সামনে বামে মোড় নিবেন।”
কাদের ড্রাইভার সামনে গিয়ে বাম দিকে একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে পড়ল। ছোট রাস্তা তাই কাদের ড্রাইভার সাবধানে তার ট্রাকটি চালিয়ে নেয়। মিজান বকশ কখনো ডানে কখনো বামে যেতে বলতে থাকে এবং মিনিট পনেরো পর একটা অন্ধকার বাড়ির সামনে থামল। বাইরে বড় গেট, কোনো একজন গেটটা খুলে দিল কাদের ড্রাইভার তখন ট্রাকটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে আসে।
ইঞ্জিনের স্টার্ট বন্ধ করতেই ট্রাকের হেডলাইট নিভে গিয়ে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। তখন একজন মানুষ ট্রাকটার দিকে এগিয়ে আসে। কাদের ড্রাইভার ট্রাক থেকে নেমে মানুষটির দিকে এগিয়ে যায়-অন্ধকারে তার চেহারা ভালো দেখা যায় না। খসখসে গলায় মানুষটি বলল, “রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয় নাই তো?”
“জে না।”
“গুড। কয়জন আনছেন।”
“বিশজন।”
“আধমরা দুর্বল রোগী আনেন নাই তো?”
কাদের ড্রাইভার মাথা নাড়ল, “জে না। পোলাপাইন সবগুলাই মোটামুটি তেজী।”
মানুষটি মাথা নাড়ল, বলল, “গুড।” তারপর মাজহারের দিকে তাকিয়ে বলল, “খোল দেখি তেরপলটা। পোলাপানগুলারে দেখি।”
মাজহার দড়ির বাঁধন খুলে তেরপলটা টেনে সরিয়ে দিল। খসখসে গলার স্বরের মানুষটা তার টর্চ লাইটটা ট্রাকের ভেতর ফেলল। ভেতরে কেউ নেই–একেবারে ফাঁকা। মানুষটা তার টর্চ লাইটটা বন্ধ করে থমথমে গলায় বলল, “ভেতরে কেউ নাই।”
কাদের ড্রাইভার আর মাজহার ইলেকট্রিকশক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। বলল, “নাই?”
“না।”
তারা মানুষটার কথা বিশ্বাস না করে নিজেরা ট্রাকের ভেতর তাকাল, সত্যিই ভেতরটা ফাঁকা। পুরোপুরি ফাঁকা। কাদের ড্রাইভার হা করে তাকিয়ে থাকে, তার নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না। বিশটা বাচ্চাকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে এখানে শুইয়ে রাখা হয়েছিল–আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে তাদের ঘুম থেকে জেগে ওঠার কথা না! একজনও নেই! কাদের ড্রাইভার আমতা আমতা করে বলল, “কই গেল ওরা?”
“প্রশ্নটার উত্তর আপনিই দেন। কই গেল?”
মাজহার ট্রাকটার আরো কাছে গিয়ে চটটাকে টেনে একটু নাড়াচাড়া করল, তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল চটটা একটু টানাটানি করলে তার নিচে লুকিয়ে থাকা বাচ্চাগুলো বের হয়ে আসবে।