মজাটাকে আরো বাড়ানোর জন্যে মজিদ বলল, “আয় ঢেলা মারি!”
মহিলাটি তখন অনেকদূর এগিয়ে গেছে, এখান থেকে ঢেলা মেরে তার গায়ে লাগাতে পারবে না। তা ছাড়া আশেপাশে অন্য মানুষজন আছে তাদের গায়ে ঢেলা লাগলে তাদের খবর হয়ে যাবে তাই মজাটাকে আজকে আর বাড়ানো গেল না।
কাউলা এততক্ষণ দুই নম্বর পাটফর্মে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎ সে ছুটতে ছুটতে তার মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে তার মায়ের কাপড় ধরে ফেলল। তার মা অবশ্যি ভ্রূক্ষেপ করল না, বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে হাঁটতে থাকল।
এরকম সময় জেবা জালালকে বলল, “এই জংলা তোর দোস্তু আইছে!”
জেবার যখন ঠাট্টা-তামাশা করার ইচ্ছা করে তখন সে জালালকে জংলা ডাকে। তার কথা শুনে সবাই খুব আনন্দ পেল, কারণ যাকে সে দোস্ত বলছে সেটি হচ্ছে একটি কুকুর। কুকুরটা স্টেশনের আশেপাশে থাকে তবে জালালের সাথে তার একটি অন্যরকম সম্পর্ক। সময় পেলেই সেটা জালালের পাশে ঘুরঘুর করে, তাকে দেখলেই লেজ নাড়ে, আহ্লাদ করে।
জালাল বস্তা থেকে নেমে কুকুরটার পাশে গিয়ে সেটাকে ধরে একটু আদর করল। এইটুকু আদরেই কুকুরটা একেবারে গলে গেল। মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে সেটি তার চার পা উপরে তুলে কুঁই কুঁই শব্দ করে সোহাগ করতে থাকে।
মজিদ হি হি করে হেসে বলল, “জংলার দোস্তু কুত্তা!”
কথাটাতে সবাই মজা পেল। হি হি করে হাসতে হাসতে সবাই বলতে লাগল, “জংলার দোস্তু কুত্তা! জংলার দোস্তু কুত্তা!”
জালাল তাদের কথায় কান দিল না, কুকুরটার পেটে হাত দিয়ে সেটাকে আদর করতে থাকে।
শাহজাহান বলল, “কুত্তারে হাত দিয়া ধরন ঠিক না।”
জেবা জানতে চাইল, “ক্যান? হাত দিয়া ধরলে কী অয়?”
“কুত্তা নাপাক। এরে ধরলে তুইও নাপাক হবি।”
জালাল মুখ ভেংচে বলল, “তরে কইছে। এই কুত্তা তোর থাইকা পরিষ্কার।”
সবাই তখন আবার হি হি করে হাসল, কারণ কথাটা সত্যি। তাদের জামা কাপড়, শরীর যথেষ্ট নোংরা, তাদের মাঝে শাহজাহান আবার বাড়াবাড়ি নোংরা এবং তাদের সবার তুলনায় এই কুকুরটা রীতিমতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
জালাল আরো কিছুক্ষণ কুকুরটাকে আদর করে বলল, “আয় কুক্কু যাই।”
জেবা বলল, “কুক্কু?”
জালাল মাথা নাড়ল, “হ। আমি এইটার নাম দিছি কুক্কু।”
“কুক্কু কী জন্যি? ভালা কুনু নাম দিতি পারলি না?”
“আমারে দেখলেই মাটিত শুইয়া কু-কু করে। এই জন্যি এর নাম হইল কুক্কু।”
.
সবাই তখন কুকুরটাকে ডাকতে লাগল, “কুক্কু! এই কুক্কু!”
কুকুরটা মনে হয় এতে বেশ মজা পেল। সেটা লেজ নেড়ে মুখটা উঁচু করে ঘেউ ঘেউ করে দুইবার ডাকল, মনে হল বুঝি বলছে, “থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”
জালাল কুকুরটাকে ডাকল, বলল, “আয় কুক্কু যাই।”
মজিদ জানতে চাইল, “কই যাস?”
“টাউনে।”
“কী জন্যি?”
“পানির বুতল বেচমু।”
তারা সবাই ট্রেন থেকে পাস্টিকের খালি পানির বোতলগুলো খুঁজে খুঁজে এনে জমা করে রাখে। সেগুলো নানা জায়গায় বিক্রি করে। জালাল তার বোতলগুলো শহরে বিক্রি করতে যায়, তার একটা কারণ আছে। কারণটা গোপন তাই সেটা কেউ জানে না, জানানো নিষেধ।
.
জালাল তার পানির খালি বোতলগুলো একটা দোকানের পিছনে রাখে। সে দোকানদারের ফাইফরমাস খাটে তাই দোকানদার জালালকে বোতলগুলো এখানে রাখতে দেয়। জালাল হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে তার খালি বোতলগুলো বের করে সেগুলো ভালো করে লক্ষ করল। যেগুলো পুরোপুরি অক্ষত সেই বোতলগুলো আলাদা করে বড় একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে ঘাড়ে নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। কুক্কু গভীর মনোযোগ দিয়ে সবকিছু লক্ষ করছিল। দেখে মনে হয় সে বুঝি সবকিছু বুঝতে পারছে।
জালাল বলল, “আয় কুক্কু যাই।”
কুক্কু লেজ নেড়ে জালালের সাথে রওনা দিল।
কুক্কুকে নিয়ে শহরে যাওয়ার অবশ্যি একটা বড় সমস্যা আছে, পথে-ঘাটে যত কুকুর আছে তার সবগুলোর সাথে সে ঝগড়া আর মারামারি করতে করতে যায়। কুকুরদের মনে হয় নিজেদের একটা এলাকা থাকে, সেই এলাকায় অন্য কুকুর এলে আর রক্ষা নেই, একটা ভয়ংকর মারামারি হবেই হবে। স্টেশনের এই পুরো এলাকাটা কুকুর দখলে, অন্য যে কুকুর আছে সবগুলো কুকুর সামনে লেজ গুটিয়ে থাকে, বাইরে থেকে নতুন কুক্কুরের ধারে কাছে আসার সাহস নেই।
স্টেশনের বাইরে গেলে অবশ্যি ভিন্ন কথা, অন্য কুকুরগুলোর তেজ তখন। একশ গুণ বেড়ে যায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সেই মাস্তান কুকুরগুলো তাদের এলাকা পাহারা দেয়। কুক্কুকে দেখেই সেগুলো ঘাড় ফুলিয়ে ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে থাকে। জালাল লক্ষ করেছে কুক্কু কীভাবে কীভাবে জানি আগেই বুঝে যায় যে সামনে কোনো একটা কুকুর তার জন্যে অপেক্ষা করছে। মনে হয় সেই জন্যে সে খানিকটা ভয়ও পায় আর সেই ভয়টাকে দূর করার জন্যে সে ঘাড় উঁচু করে –থাকে, চাপা গরগর শব্দ করে। কুকুর বীরত্বটুকু অবশ্যি বেশিরভাগই জালালের জন্যে, সে জানে হঠাৎ করে যদি অনেকগুলো মাস্তান কুকুর তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তা হলে জালাল তাকে রক্ষা করবে। মনে হয় বড় একটা কুকুরও ছোট একটা মানুষকে অনেক ভয় পায়।
জালাল কুক্কুকে সামলে সুমলে নিয়ে যেতে থাকে। কাজটা মোটেও সোজা না। কুক্কু মাঝে মাঝেই নিজেই আগ বাড়িয়ে অন্য কুকুরদের সাথে মারামারি করতে যায়। শুধু তাই নয় প্রত্যেকবার নতুন এলাকাতে গিয়ে একটা লাইটপোস্টের সামনে এসে সে তুলে একটুখানি পেশাব করে ফেলে! জালালের মনে হয় এটা করে কুক্কু এই এলাকার সব কুকুরকে অপমান করার চেষ্টা করে। তার ভাবখানা এইরকম যে, এই দেখ আমি তোমার এলাকায় পেশাব করে দিয়ে যাচ্ছি তোমরা কিছুই করতে পারছ না!