কাদের ড্রাইভার তার সিগারেটে টান দিয়ে বলল, “চায়ের তিয়াশ হইছে।”
“সামনে লাকি রেস্টুরেন্ট। ফাস্ট ক্লাশ চা বানায়।” মাজহার জিজ্ঞেস করল, “থামবেন?”
“আয় থামি।”
কিছুক্ষণের ভেতরে তারা লাকি রেস্টুরেন্টের সামনে পৌঁছে গেল। এই রেস্টুরেন্টটা তৈরি হয়েছে ট্রাক ড্রাইভারদের জন্যে। বেশ কয়েকটা ট্রাক সামনে ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে। কাদের ড্রাইভার একটা ট্রাকের পিছনে তার ট্রাকটা পার্ক করল। তারপর ট্রাক থেকে নেমে ট্রাকটার চারিদিকে ঘুরে এল। তারপর মাজহারকে বলল, “আয়। চা খাই।”
“আমি কি ট্রাক পাহারা দিমু?”
“এই ট্রাক পাহারা দিয়ে কী করবি। পোলাপান ঘুমায়–চব্বিশ ঘণ্টার আগে এরা উঠব না।”
“ঠিক আছে।” তারপর দুইজন হাঁটতে হাঁটতে লাকি রেস্টুরেন্টে চা খেতে গেল।
.
ঠিক তখন ট্রাকের ভেতরে সবগুলো বাচ্চা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। জালাল বলল, “এখন বাইর হতি হবে। দেরি করা যাবে না।”
একজন ভয় পাওয়া গলায় বলল, “বাইর হইয়া কই যামু?”
জালাল তেরপল থেকে মাথা বের করে চারপাশে দেখল, তারপর বলল, “সামনে চায়ের দোকান-ঐদিকে যাওয়া যাবি না। রাস্তা পার হয়া পিছন দিকে যাবি-ঐখানে গাছের পিছনে লুকাবি। কেউ যেন না দেখে। প্রথম কে বের হবি?”
কেউ একজন বলল, “আমি।”
“ঠিক আছে। বের হ–”
দেখা গেল বের হওয়া খুব সোজা না। তেরপলটা টেনে বের হওয়ার জন্যে যেটুকু জায়গা করা হয়েছে সেই জায়গাটা খুব বেশি না–খানিকটা গিয়ে ছেলেটা আটকে গিয়ে যন্ত্রণার মতো শব্দ করতে থাকে।
জালাল বলল, “আস্তে! চিল্লাইস না–” তারপর উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে তাকে নামানোর চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত ছেলেটা ছোট ফুটো দিয়ে বের হয়ে ধুপ করে নিচে পড়ল। পেটের ছাল উঠে গিয়েছে কিন্তু সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার সময় নাই।
জালাল জিজ্ঞেস করল, “কেউ দেখে নাই তো?”
“না।”
“তুই একটু খাড়া–ছোট একটারে নামাই।”
তারপর ছোট একজনকে উপর থেকে ধরে আস্তে আস্তে নিচে নামাল। ট্রাকটা অনেক উঁচু কাজেই একসময় ছেড়ে দিতে হল এবং বাচ্চাটা ধুপ করে নিচে পড়ল। জালাল শুনতে পেল নিচে পড়ে বাচ্চাটা যন্ত্রণার একটা শব্দ করল-সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাল না–চাপা স্বরে বলল, “পালা।”
দুইজন তখন রাস্তা পার হয়ে অন্যদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এরপর একজন একজন করে বের হতে থাকে, বের হওয়ার সাথে সাথেই না চলে গিয়ে একজন পরের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে–তাকে টেনে নামাতে সাহায্য করে। বের হওয়ার গর্তটা ছোট তাই মাঝে মাঝেই একজন-দুইজন সেখানে আটকে যাচ্ছিল তখন অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। ভেতর থেকে চা খেয়ে যখন ট্রাক ড্রাইভাররা তাদের ট্রাকে ফিরে আসছিল তখনো তারা বের হচ্ছিল না। অন্য ট্রাক ড্রাইভারদের বিশ্বাস করা যাবে কি না তারা বুঝতে পারছিল না-তাই কোনো ঝুঁকি নিল না।
যখন সবাই বের হয়ে গেছে শুধু জালাল বাকি ঠিক তখন দেখা গেল কাদের ড্রাইভার আর মাজহার চা খেয়ে লাকি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আসছে। ট্রাকের পাশে এইমাত্র বের হয়ে যে মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, “ড্রাইভার আসছে।”
জালাল বলল, “পালা।”
মেয়েটা দ্রুত পালিয়ে গেল কিন্তু জালাল বের হতে পারল না, ট্রাকের মাঝে আটকা পড়ে গেল।
কাদের ড্রাইভার আর মাজহার দুইজনে মিলে পুরো ট্রাকটা আবার ঘুরে দেখে। তেরপলের যে অংশে একটু জায়গা করে সবাই বের হয়েছে সেখানে এসে কাদের ড্রাইভার আর মাজহার দাঁড়িয়ে গেল। কাদের ড্রাইভার বলল, “এইখানে ফাঁকা কেন?”
মাজহার বলল, “মনে হয় ঠিক করে বান্ধি নাই।” সে একটু উঁকি দিয়ে দেখল, তারপর তেরপলটা টেনে বের হওয়ার জন্যে যে জায়গাটা ফাঁক করা হয়েছিল সেটা বন্ধ করে দিল। ভেতরে বসে থেকে জালালের মনে হল সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদে।
কাদের ড্রাইভার আর মাজহার ট্রাকে ওঠে। জালাল শুনতে পেল ইঞ্জিনটা স্টার্ট হয়েছে, ট্রাকটা একটা ঝাঁকুনি দিল তারপর আস্তে আস্তে নড়তে শুরু করে। হঠাৎ করে জালাল বুঝতে পারল সে যদি এখনই ট্রাক থেকে বের হতে না পারে তা হলে আর কোনোদিন বের হতে পারবে না।
জালাল লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, বের হওয়ার যে অংশটুকুতে তেরপলটা টেনে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জালাল সেখানে হাত ঢুকিয়ে ধাক্কা দিয়ে বের হবার রাস্তা করার চেষ্টা করতে থাকে। প্রথমে মনে হয় সে বুঝি পারবে না, কিন্তু শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দেবার পর একটুখানি তেরপল সরে যায়–জালাল চলন্ত ট্রাক থেকে নিচের রাস্তাটা দেখতে পেল। দেখতে দেখতে ট্রাকের বেগ বাড়তে থাকে–কিছুক্ষণের মাঝে ট্রাকটা এতো জোরে যেতে থাকবে যে বের হওয়ার রাস্তা থাকলেও সে আর বের হতে পারবে না।
জালাল আর দেরি না করে ফাঁকা অংশটি দিয়ে তার শরীর বের করে দেয়, ঘাড় আর মাথা আটকে গিয়েছিল ধাক্কা দিয়ে সেটি ছুটিয়ে নিতে চেষ্টা করে, শেষ পর্যন্ত ছুটিয়ে এনে সে বের হয়ে আসে, কোনোমতে সে তেরপলটা ধরে ঝুলে থাকে। শরীরের নিচ দিয়ে রাস্তাটা ছুটে যাচ্ছে, হাতটা ছাড়লেই সে রাস্তায় পড়বে এবং সাথে সাথে ট্রাকের পিছনের চাকা তাকে পিষে ফেলবে। কাজেই তাকে শুধু নিচে রাস্তায় পড়লেই হবে না ছিটকে ট্রাকের নিচ থেকে সরে আসতে হবে যেন ট্রাকের চাকা তাকে পিষে ফেলতে না পারে।