দুইজন দুইজন করে বিশটি বাচ্চাকে নামিয়ে আনা হল এবং সবাইকে ট্রাকের ভেতরে খড়ের উপর চটের বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল। শুইয়ে দেওয়ার পর তাদের মুখের আর হাতের টেপ খুলে দেওয়া হল–সবাই নিশ্চয়ই এতক্ষণে গভীর ঘুমে অচেতন। এখন এগুলোর আর দরকার নেই।
মন্তাজ মিয়া আবছা অন্ধকারে সারি বেঁধে শুয়ে থাকা বাচ্চাগুলোকে একনজর দেখে শেষবারের মতো গুনে ট্রাক ড্রাইভারকে বলল, “কাদের ভাই, এই যে তোমারে আমি কুড়িটা বাচ্চা বুঝায়া দিলাম। এরা যে ঘুম দিছে আগামী চব্বিশ ঘণ্টায় সেই ঘুম ভাঙব না। এখন দায়-দায়িত্ব তোমার।”
“এক-দুইটা মইরা যাইব না তো?”
“হেইডা আমি জানি না।”
“মরলে কিন্তু আমার দোষ নাই।”
মন্তাজ মিয়া মাথা নাড়ল, “না তোমার দোষ নাই। তুমি ওগো ওষুধ খাওয়াও নাই। ওষুধ খাওয়াইছি আমরা। মরলে দায়ী আমরা। যাও। আল্লাহর নাম নিয়া রওনা দাও।”
কাদের ড্রাইভার একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আল্লাহর নাম নিয়া রওনা দিমু? মন্তাজ তোমার কী ধারণা এই বাচ্চাগুলানরে আমরা ইন্ডিয়া পাচার করতাছি হেইডা দেইখাও আল্লাহ্ কী আমাগো দিকে থাকব?”
মন্তাজ মিয়া ধমক দিয়া বলল, “বড় বড় কথা কওনের দরকার নাই। রওনা দেও। আল্লাহর নাম নিতি না চাইলে নিও না। যাও।”
তেরপল দিয়ে ট্রাকটা ভালো করে ঢেকে দেওয়ার পর ভেতরের অংশটা কুচকুচে অন্ধকার হয়ে গেল। ট্রাকটা না ছাড়া পর্যন্ত সবাই চুপচাপ শুয়ে রইল, যেই ট্রাকটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করে সাথে সাথে সবাই উঠে বসে যায়। জালাল ফিস ফিস করে বলল, “সবাই ঠিক আছ?”
সবাই গলা নামিয়ে বলল, “আছি।”
অন্ধকারের ভেতর কেউ একজন বলল, “এখন আমরা কী করমু?”
“প্রথমে তেরপলটা একটু খুলতে হবে যেন ভেতর থেকে বের হতে পারি। তারপর অপেক্ষা করতি হবে। যখন ট্রাকটা কুননা জায়গায় থামব আমরা নাইমা দিমু দৌড়।”
“ট্রাকটা কখন থামবি?”
“হেইডা তো জানি না।”
“যদি না থামে?”
“থামবি। নিশ্চয়ই থামবি।”
অন্ধকারে কেউ একজন বলল, “টেরাক ডেরাইভাররা টেরাক থামাইয়া সবসময় চা খায়।”
আরেকজন বলল, “হ। খালি চা না হেরা বাংলা মদও খায়।”
জালাল বলল, “একটা কথা হুনো সবাই।”
“কী কথা?”
“আমরা চেষ্টা করুম গোপনে নামবার। কিন্তু যদি মনে কর তারা দেখি ফেলে তা হলে সবাই দৌড় দিবা।”
“ঠিক আছে।”
“সবাই একদিকে দৌড় দিবা না। একেকজন একেক দিকে।”
“ঠিক আছে।”
“পিছন দিকে তাকাবা না। আল্লাহ্র নাম নিয়া দৌড় দিবা।”
“ঠিক আছে।”
ট্রাকটা গর্জন করে যেতে থাকে। কোন দিক দিয়ে যাচ্ছে বোঝার কোনো উপায় নেই। কিন্তু হর্নের শব্দে, হঠাৎ হঠাৎ ব্রেক করা দেখে তারা অনুমান করতে পারে এটা এখনো শহরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে ভেতর থেকে তারা তেরপলটা খোলার চেষ্টা করতে থাকে। ভারী শক্ত তেরপল বাইরে দিয়ে বাঁধা, তাই খোলা প্রায় অসম্ভব। চারিদিকে চেষ্টা করে টানাটানি করে ডানদিকের মাঝামাঝি তারা একটা জায়গায় খানিকটা ফাঁক করতে পারল। অনেক চেষ্টা করে তারা খানিকটা তেরপল সরিয়ে মোটামুটি বের হবার মতো খানিকটা জায়গা করে ফেলতে পারল।
এখন শুধু অপেক্ষা করা কখন ট্রাকটা থামবে। কিন্তু ট্রাকটা থামল না যেতেই থাকল, যেতেই থাকল। ভেতরে এক ধরনের ভ্যাপসা গরমের মাঝে বাচ্চাগুলো বসে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। তাদের কারো চোখে ঘুম নেই-সবার বুকের ভেতর চাপা আতঙ্ক। শেষ পর্যন্ত তারা সত্যিই পালাতে পারবে তো?
.
১২.
কাদের ড্রাইভার একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “বুঝলি মাজহার কামটা ঠিক কি না বুঝবার পারি না।”
মাজহার নামের হেল্পার ড্রাইভারের পাশে বসে বসে ঝিমাচ্ছিল, কাদের ড্রাইভারের কথা শুনে জেগে উঠল। জিজ্ঞেস করল, “কোন কামটা ওস্তাদ?”
“এই যে ছোটো ছোটো পোলাপানদের ইন্ডিয়া পাচার করি।”
মাজহার তার ময়লা দাঁত বের করে হি হি করে হাসল, বলল, “কী বলেন ওস্তাদ। এই পোলাপানগুলি কি বড় হইয়া জজ-বেরিস্টর হইব? এরা তো চোর ডাকাইত ফকিরনিই হইব। তয় এইটা এই দেশে হইলেই কী আর ইন্ডিয়াতে হইলেই কী? মাঝখানে আমাগো কিছু ইনকাম।”
কাদের ড্রাইভার স্টিয়ারিং ধরে একটা লক্কর-ঝক্কর বাসকে বিপজ্জনকভাবে ওভারটেক করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “তারপরেও জানি কেমন কেমন লাগে। মনে হয় কামটা ঠিক হইল না।”
মাজহার কিছু বলল না। তার ওস্তাদের অনেক কথা সে বুঝতে পারে না। তাদেরকে কিছু মাল এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতে বলেছে–তারা নিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে কোন জিনিসটা অন্যায়? এখন সেই মালটা কী গরুর বাচ্চা না মানুষের বাচ্চা সেইটা নিয়ে তার চিন্তা করতে হবে কেন? ইন্ডিয়ার গরু যখন ট্রাকে করে আনে তখন তো তার ওস্তাদ মন খারাপ করে না।
কাদের ড্রাইভার আরেকটা বাসের পিছন পিছন যেতে যেতে বলল, “তারপর মনে কর পুলিশ
“পুলিশের কী হইছে ওস্তাদ?”
“যদি ধরে?”
“সেইটা তো আমাগো চিন্তা না। পুলিশরে তো আগে থেকে রেডি কইরা রাখা হইছে। ওগো টাকা-পয়সা দিছি-ওরা আমাগো ধরব ক্যান?”
“মাজহার–তোরে একটা জিনিস বলি। সব জিনিস টাকা-পয়সা দিয়া হয় না। এই পুলিশের মাঝেও ভালো পুলিশ আছে–তাগো হাতে যদি ধরা পড়ি তখন টাকা-পয়সা দিয়া ছুটবার পারবি না। তখন জন্মের মতো শেষ।”
মাজহার তার ময়লা দাঁত বের করে হাসল। বলল, “হেইডা নিয়া আপনার চিন্তা করনের কিছু নাই। তারা আমাগো ধরব না। হেইডা বড় বড় ওস্তাদের দায়িত্ব। আমরা ধরা খাইলে তারা কি আর ছুঁইটা যাইব? তারাও ধরা খাইব।”