সবাই মাথা নাড়ল এবং মুখে ভয় আতঙ্ক হতাশা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে লাগল। জালাল নিচু গলায় বলল, “একটু পরে আমাগো খাবার দিব। তোরা ভান করবি তোগো খাওয়ার ইচ্ছা করছে না–কিন্তু সবাই ঠিক করে খাবি। পেট ভরে খাবি। যদি মাইরপিট করতে হয় দৌড়াদৌড়ি করতি হয় তা হলে শরীলের মাঝে জোর থাকতি হবি।”
সবাই আবার মাথা নাড়ল। গোলগাল চেহারার একটা মেয়ে জেবার থেকে এক-দুই বছরের বড় হতে পারে একটু এগিয়ে এসে জালালের হাত ধরে বলল, “তোমার নাম কী?”
“জালাল।”
“জালাল, ভাইটি আমার। তুমি আমারে কথা দাও, তুমি আমারে বাঁচাবে। কথা দাও।”
জালাল অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল, কী বলবে বুঝতে পারল না, একটু ইতস্তত করে বলল, “তোমার কুনো ভয় নাই। আমি তোমারে বাচামু। খোদার কসম।”
গোলগাল মেয়েটি জালালের হাত ধরে রাখল আর তার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়তে থাকে।
.
কিছুক্ষণ পর জরিনি খালা আর মন্তাজ মিয়া অনেকগুলো খাবারের প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকল। মেঝের মাঝে বাক্সগুলো রেখে বলল, “এই আবাগীর বেটাবেটি। খা। যদি ঠিক কইরা না খাস ঠ্যাং ভাইঙা দিমু।”
কেউ কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে রইল।
মন্তাজ মিয়া খেঁকিয়ে উঠল, “কী হইল? কথা কানে যায় না? খা কইলাম।”
এবারে বাচ্চাগুলো একটু নড়েচড়ে বসে। জেবা সাবধানে একটা প্যাকেট নিজের দিকে টেনে আনে। জরিনি খালা বলল, “দুইজনে একটা কইরা প্যাকেট। কুনো খাবার যেন না থাকে। সব খাবার শেষ করতি হবে। খা।”
বাচ্চাগুলো প্যাকেটগুলো নেয় এবং খেতে শুরু করে। জরিনি খালা বিছানায় বসে তীক্ষ্ণ চোখে সবাইকে দেখে। এদের সবাইকে অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে, পরের বার কোথায় খাবে কী খাবে জানা নেই। এখনই ভালো করে খাওয়া দরকার। তা ছাড়া এদেরকে যে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হবে সেটা খুব খারাপ একটা ওষুধ, খালি পেটে খেলে সমস্যা হতে পারে।
জরিনি খালা আর মন্তাজ মিয়া ভেবেছিল বাচ্চাগুলো খেতে পারবে না–কিন্তু যখন দেখল সবাই চেটেপুটে খেল তখন তারা বেশ অবাক হল, খুশি হল আরো বেশি। খাওয়ার পরই তারা আধ লিটারের একটা ছোট পানির বোতল নিয়ে আসে, বোতলটা ভালো করে ঝাঁকিয়ে জরিনি খালা একটা চা চামুচে পানিটা ঢালল। মন্তাজ মিয়া তখন হাতের কাছে যে বাচ্চাটাকে পেল সেটাকে খপ করে ধরে নিয়ে বলল, “হা কর।”
বাচ্চাটি খুব ভালো করে জানে কেন তাকে হা করতে বলা হয়েছে, তারপরও সে অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “ক্যান? হা করমু ক্যান?”
মন্তাজ মিয়া উত্তর দেওয়ার কোনো চেষ্টা না করে তার লোহার মতো শক্ত আঙুল দিয়ে তার দুই গালে এতো শক্ত করে চেপে ধরল যে তার মুখটা হা করে খুলে গেল। জরিনি খালা তার চায়ের চামুচ দিয়ে দুই চামুচ পানি তার মুখে ঢেলে দিল। মন্তাজ মিয়া তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “খা। গিলে খা।”
বাচ্চাটি ঢোক গিলল, মন্তাজ মিয়া সন্তুষ্ট হয়ে তখন পরের জনকে ধরে আনল। এই বাচ্চাটিও দুর্বলভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। মন্তাজ মিয়া আর জরিনি খালা মিলে তার মুখেও দুই চামুচ ওষুধ ঢেলে দিয়ে তাকে দিয়ে সেটা ঢোক গিলে খেয়ে ফেলতে বাধ্য করল।
মিনিট দশেকের মাঝেই সবগুলো বাচ্চাকে দুই চামুচ করে ওষুধ খাইয়ে দেওয়া হল–অন্তত মন্তাজ মিয়া আর জরিনি খালা তাই ভাবল। বাচ্চাগুলো জানে এখন তাদের ভান করতে হবে যে তাদের ঘুম পেতে শুরু করছে। তারা সবাই কম-বেশি অভিনয় শুরু করল। একজন ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল, আরেকজন হাঁটুতে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করল। কয়েকজন মেঝেতে শুয়ে পড়ল। কয়েকজন অন্যজনের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল।
মন্তাজ মিয়া আর জরিনি খালা একটু অবাক হয়ে বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। মন্তাজ মিয়া বলল, “এই ওষুধের তেজ দেখি অনেক বেশি। ওস্তাদ কইছিল দশ-পনেরো মিনিট পরে ঘুম পাড়ব। এরা তো দেখি সাথে সাথে ঘুম যাচ্ছে।”
জরিনি খালা বলল, “বয়স কম, সেই জন্যে মনে লয়।”
“বেশি ঘুমাইলে ট্রাকে ভোলা সমিস্যা হতি পারে। এখনই ট্রাকে ভোলা শুরু করতি হবে।”
জরিনি খালা মাথা নাড়ল, বলল, “দেরি করা যাবি না। আমি পাহারা দেই তুমি দুইটা দুইটা কইরা নামাও।”
মন্তাজ মিয়া চওড়া এক রোল টেপ নিয়ে আসে, সেখান থেকে খানিকটা ছিঁড়ে তাদের মুখে লাগাল যেন কথা বলতে না পারে তারপর আরো খানিকটা ছিঁড়ে তাদের দুই হাত পিছনে নিয়ে সেখানে লাগাল যেন হাত দুইটা ব্যবহার করতে না পারে। হাত পিছনে বাঁধা থাকলে হঠাৎ করে কেউ দৌড় দিতে পারে না।
মন্তাজ মিয়া তারপর বাচ্চা দুইজনের ঘাড় ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে আনে। লাইট নিভিয়ে সবকিছু অন্ধকার করে রাখা আছে তার মাঝে বাচ্চা দুইজনকে ট্রাকে তুলে দেওয়া হল। ট্রাকের ভেতরে একজন বসেছিল সে দুইজনকে ট্রাকের মাঝে উপুড় করে শুইয়ে দিল। বাচ্চা দুটো নড়াচড়া করল না, চুপচাপ শুয়ে রইল। মন্তাজ মিয়া বলল, “এক নম্বর ওষুধ। আধা ফোঁটা ওষুধেই কলাগাছের মতোন ঘুম।”
ট্রাকের ভেতরে বসে থাকা মানুষটা বলল, “কথা ভুল কও নাই। সত্যি কথা ছোট পুলাপান বড় যন্ত্রণা করে। একবার ঘুমাইলে শাস্তি।”
যে দুইজনকে নিয়ে তারা কথা বলছিল সেই দুইজন কিন্তু আবছা অন্ধকারে চোখ পিট পিট করে সবাইকে দেখছে। তাদের চোখে কোনো ঘুম নেই তারা পুরোপুরি সজাগ হয়ে কিছু একটা করার জন্যে অপেক্ষা করছে।