.
১১.
মন্তাজ মিয়া জালালকে পাশের ঘরে নিয়ে মারতে চাচ্ছিল জরিনি খালা তাকে থামাল, বলল, “মারিস না। তোর হাতে মাইর খাইলে ভর্তা হইয়া যাইব। এরে যদি ইন্ডিয়া পাঠাবার চাই তাজা রাখন দরকার।”
জরিনি খালার কথায় যুক্তি আছে, তাই মন্তাজ মিয়া চুলের মুঠি ধরে দুই চারটা ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই ঢুকলি কেমনে?”
জালাল বলল, বিল্ডিংয়ের পিছনে পাইপ বেয়ে উঠেছি। মন্তাজ মিয়া হুংকার দিয়ে বলল, “মিছা কথা কইবি না। তুই কি টিকটিকির বাচ্চা যে পাইপ বায়া উঠবি?”
জালাল সত্যি কথাটা বলল। সে আসলেই পাইপ বেয়ে উঠেছে। সে যে কোনো দেয়াল, গাছ বা পাইপ বেয়ে যখন খুশি উঠতে পারে। মন্তাজ মিয়া তখন জানতে চাইল সে কেমন করে এই বিল্ডিংটার খোঁজ পেয়েছে তখন জালাল আবার সত্যি কথাটা বলল, সেই স্টেশন থেকে ট্রেনে তাদের পিছু পিছু এসেছে, বাসে পিছু পিছু এসেছে রিকশায় পিছু পিছু এসেছে। মন্তাজ তখন জানতে চাইল, সে কেমন করে বুঝতে পারল বিল্ডিংয়ের দোতালায় উঠতে হবে। জালাল সত্যি কথাটি বলল, নিচে থেকে সে জরিনি খালাকে এই দোতালার বারান্দায় দেখেছে। মন্তাজ মিয়া তখন জানতে চাইল জরিনি খালা ঢুকেছে বিকালে সে এতোক্ষণ কোথায় ছিল। জালাল আবার সত্যি কথাটা বলল, সে অন্ধকার হয়ে চারিদিক নির্জন হয়ে যাবার জন্যে অপেক্ষা করছিল। অন্ধকার হবার পর পাইপ বেয়ে উঠেছে। মন্তাজ মিয়া তখন জানতে চাইল সে কখন পাইপ বেয়ে ঢুকেছে? জালাল তখন প্রথম একটা মিথ্যা কথা বলল, “আমি এইমাত্র ঢুকছি। কাউরে না পাইয়া ইদিক-সিদিক হাঁটছি–এই দরজাটা বন্ধ দেইখা এইটা খুইলা ঢুকছি।”
মন্তাজ মিয়া চুল ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দেয়ালে তার মাথাটা ঠুকে হুংকার দিয়ে বলল, “সত্যি কইরা কথা ক।”
জালাল কাতর গলায় বলল, “সত্যি কইতাছি। খোদার কসম। আল্লাহর কিরা।” একটা মিথ্যা কথা বলে আল্লাহ্ এবং খোদাকে নিয়ে কিরা আর কসম কাটার জন্যে সে মনে মনে খোদার কাছে মাফ চেয়ে নিল।
মন্তাজ মিয়া শেষ পর্যন্ত জালালের কথা বিশ্বাস করে তাকে ঘাড় ধরে এনে দরজার ছিটকিনি খুলে ভেতরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।
দরজাটা বন্ধ হবার সাথে সাথে মায়া আর জেবা এবং তার সাথে সাথে অন্যরাও তাকে ঘিরে ধরল। মায়া ফ্যাস ফ্যাস করে কাঁদছে। চোখের পানি নাকের পানিতে তার মুখ নোংরা হয়ে আছে। জেবার চোখে-মুখে আতঙ্ক, মুখ ফ্যাকাসে এবং রক্তহীন। শুকনো মুখে বলল, “অহন কী হইব আমাগো?”
জালাল গরম হয়ে বলল, “তোদের জন্যে এই অবস্থা। আমি একশবার তোগো কই নাই জরিনি খালা ছেলেধরা? আমার কথা তোরা বিশ্বাস করলি না। এই বদমাইস বেটির পিছে পিছে ঢাকা চইলা আইলি?”
জেবা কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে রইল। মায়া ফ্যাস ফ্যাস করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “জরিনি খালা কইল আমাগো নতুন জামা দিব, পেরতেক দিন বিরানি খাইতি দিব, সোন্দর সোন্দর বিছানা-বালিশ দিব, আদর করব”
জালাল দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “আর তুই সেই কথা বিশ্বাস করলি? বেকুবের বেকুব–”
জেবা দুর্বল গলায় বলল, “অহন গাইলমন্দ কইরা লাভ কী?”
কাছাকাছি বসে থাকা আরেকটা মেয়ে বলল, “আমাগো কী করব?”
জালাল একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “নিচে একটা ট্রাক খাড়ায়া আছে, আমাগো সেই ট্রাকে তুলব, ট্রাকে কইরা ইন্ডিয়া নিব।”
জেবা বলল, “আমরা তহন চিল্লাফাল্লা করমু।”
“তেরপল দিয়া ঢাইকা রাখব। ট্রাকের ইঞ্জিনের অনেক শব্দ, কেউ শুনবার পাইব না।”
কাছাকাছি বসে থাকা মেয়েটা বলল, “মানুষগুলান খুব খারাপ, আমাগো জানে মাইরা ফালাইব।”
জেবা বলল, “ইন্ডিয়া নিলে কি আমাগো বাঁচাইয়া রাখব? যেই অত্যাচার করব তার থাইকা মাইরা ফালাইলেই ভালা।”
আশেপাশে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলো নিশ্বাস ফেলে। দুই-একজন কাঁদতে শুরু করে। জালাল বলল, “কান্দিস না। আমাগো এখনো চেষ্টা করতি হবি।”
“কেমনে চেষ্টা করমু?”
“আমি বলি, তোরা হুন।”
সবাই তখন একটু কাছাকাছি এগিয়ে আসে। বেশির ভাগই মেয়ে-বয়স মায়ার থেকে ছোটও আছে আবার জেবার থেকে এক-দুই বছর বেশিও আছে। বেশিরভাগই গরিবের বাচ্চা তবে এক-দুইজনকে দেখে মনে হল বড়লোকের ঘর থেকে এসেছে-এখন আর সেইটা নিয়ে খোঁজ-খবর নেওয়ার সময় নাই।
জালাল বলল, “আমি যেই কথাটা কই সবাই মন দিয়া শুন। কথা বলার বেশি সময় নাই। বাঁচনের একটা উপায়-হগগলের একসাথে থাকন লাগব। বুঝছ সবাই?”
সবাই মাথা নাড়ল। জালাল তখন তাদেরকে বলল খুব কড়া একটা ওষুধ খাইয়ে তাদের ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হবে-কিন্তু সে সেই ওষুধটা ফেলে সেখানে পানি ভরে রেখেছে, তাই ওষুধটা খাওয়ালেও তারা আসলে ঘুমিয়ে পড়বে না। যখন তাদের ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করবে তখন সবাই যেন ভান করে তারা এটা খেতে চায় না কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেন খেয়ে নেয়। এটা খাওয়ার কিছুক্ষণ পর তাদের ঘুমিয়ে পড়ার কথা তাই তারা যেন একটু পরে ঘুম ঘুম ভান করে। ওদেরকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জানলে তারা আর তাদের নিয়ে মাথা ঘামাবে না–তখন তারা সবাই মিলে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করবে।
জালালের কথা শুনে সবাই উত্তেজিত হয়ে ওঠে, তাদের চোখ চকচক করতে থাকে–দুই-একজনের মুখে হাসি পর্যন্ত ফুটে ওঠে। জালাল মুখ গম্ভীর করে বলল, “খবরদার কেউ হাসবি না। সবাই মুখ কালা করে রাখবি। তারা যেন টের পায় আমাগো মাথার মাঝে অন্য বুদ্ধি। বুঝলি?”