জালাল পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে, অনেকগুলো বাচ্চাকে নেওয়া খুব সোজা, ঘুম পাড়িয়েই নিতে হবে। কিন্তু যদি ঘুম পাড়িয়ে না দেওয়া যায়, সবাই যদি চিৎকার চেঁচামেচি করে তা হলে বাঁচার একটা উপায় আছে। ঘুমের ওষুধটা যদি
পানি দিয়ে পাল্টে দেওয়া যায় তা হলে মনে হয় একটা সুযোগ হবে।
জালাল সাবধানে ঘরের ভেতর ঢুকল। টেবিল থেকে শিশিটা নিয়ে সে পাশের বাথরুমে ঢুকে যায়। শিশিটা খুলে ভেতরের তরল পদার্থটা সিংকের মাঝে ঢেলে ফেলে দেয়–হালকা একটা ঝাঁঝালো গন্ধ তার নাকে এলো। ট্যাপ খুলে পানি দিয়ে শিশিটা একটু ধুয়ে নিয়ে সেখানে পানি ভরে শিশিটার মুখ বন্ধ করে আবার ঘরটাতে ফিরে এসে টেবিলের উপর রেখে দেয় তারপর খুব সাবধানে পা টিপে টিপে পাশের ঘরে ঢুকল। ঘরটা ছোট, মাঝখানে একটা খাট। খাটের উপর নেতিয়ে থাকা তোষক এবং ময়লা চাদর। একটা সবুজ রঙের মশারি উপর থেকে ঝুলছে। জালাল খাটের নিচে ঢুকে গেল।
খাটের নিচে থেকে অন্যপাশের ঘরটা দেখা যাচ্ছে, দরজা খোলা, ভেতরে ওস্তাদ, জরিনি খালা আর মন্তাজ মিয়া ঢুকেছে। তাদের গলার স্বর ছাপিয়ে ছোট বাচ্চাদের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শোনা যেতে থাকে।
জালাল শুনতে পেল মন্তাজ মিয়া একটা হুংকার দিয়ে বলল, “চোপ! না হলে কল্লা টেনে ছিঁড়ে ফেলমু।”
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দটা সাথে সাথে থেমে গেল।
এবারে ওস্তাদের গলার শব্দ শোনা গেল, সে সবাইকে গুনছে, গোনা শেষ করে বলল, “উনিশজন।”
জরিনি খালা বলল, “হ্যাঁ।”
ওস্তাদ বলল, “কুড়িজন ডেলিভারি দিবার কথা। একটা শর্ট পড়ল।–”
জরিনি খালা বলল, “পরের বার একটা বেশি দিলেই হবি।” তারপর নিচু গলায় কী যেন বলল, সেটা শুনে সবাই হেসে উঠল।
কিছুক্ষণ পর খোলা দরজা দিয়ে প্রথমে ওস্তাদ পিছু পিছু মন্তাজ মিয়া আর জরিনি খালা বের হয়ে এলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওস্তাদ বলল, “আমি গেলাম।”
জরিনি খালা বলল, “আমিও যামু।”
“তুই থাক। মন্তাজরে সাহায্য কর। একলা পারব না। কাল ভোরে যাবি।”
“ঠিক আছে।”
তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে তিনজন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। মানুষগুলো সরে যেতেই জালাল খাটের নিচ থেকে বের হয়ে এলো, সে যেটা দেখতে এসেছিল সেটা দেখে ফেলেছে। জরিনি খালা মায়ের মতো আদর করে বড় করার জন্যে মায়া আর জেবাকে আনেনি, তাদেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এনেছে বিক্রি করার জন্যে। বাজারে যেভাবে গরু-ছাগল বিক্রি হয় তাদেরকে ঠিক এভাবে বিক্রি করা হচ্ছে।
যেভাবে পাইপ বেয়ে উপরে উঠেছিল ঠিক সেইভাবে এখন পাইপ বেয়ে তাকে নেমে যেতে হবে, তারপর বাইরে কাউকে খবর দিতে হবে। তার কথা কেউ শুনতে চাইবে না কিন্তু তাকে জোর করে কথা শোনাতে হবে। যেভাবে হোক।
পা টিপে টিপে বের হবার আগে জালাল হঠাৎ থেমে গেল। ঐ বন্ধ ঘরটাতে উনিশটা বাচ্চা নিশ্চয়ই ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। বেচারি মায়া আর জেবা নিশ্চয়ই এখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার কী একবার ভেতরে ঢুকে তাদের বলা উচিত না যে–ভয় পাওয়ার কিছু নেই–সে বাইরে গিয়ে পুলিশকে খবর দিবে। পুলিশ তাদেরকে উদ্ধার করে নেবে।
জালাল আবার পা টিপে টিপে আগের ঘরে ফিরে এলো। খুব সাবধানে ছিটকিনি খুলে সে দরজাটা একটু ফাঁক করে ভেতরে মাথা ঢোকায়। একটা বড় খাটের উপরে এবং নিচে জড়াজড়ি করে অনেকগুলো বাচ্চা বসে আছে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই প্রথমে বাচ্চাগুলো ভয় পেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। জালালকে দেখে হঠাৎ সবাই চুপ করে তার দিকে তাকাল।
জেবা অবাক হয়ে চিৎকার করে উঠতে চাইছিল জালাল ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করতে বলল, সাথে সাথে জেবা চুপ করে গেল। জালাল পা টিপে টিপে কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল, “ডরাইস না।”
“তুই কোত্থেকে আইছস?”
“আমি তোগো পিছ পিছ আইছি। কথা কওনের সময় নাই। আমি বাইরে গিয়া পুলিশরে খবর দিমু।”
সবগুলো বাচ্চা চোখ বড় বড় করে জালালের দিকে তাকিয়ে রইল। জালাল সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “কুনো ভয় নাই। আমি পুলিশরে খবর দিমু।”
মায়া কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন জালাল শুনতে পেল বাইরে মন্তাজ মিয়া বলছে, “এই জরিনা, দরজা খোলা কেন?”
জরিনি খালা বলল, “হেইডাতো জানি না।”
“ভিতরে কে ঢুকছে?”
ধড়াম করে দরজা খুলে মন্তাজ মিয়া আর জরিনি খালা ভেতরে ঢুকল। দুইজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকায়। মন্তাজ মিয়া বলল, “পোলা-মাইয়া ছাড়া তো আর কাউরে দেখি না।”
জরিনি খালা বলল, “গুনে দেখ, বেশি আছে কি না।”
মন্তাজ মিয়া গুনতে শুরু করে, উনিশজন ছিল, গুনে দেখা গেল একজন বেশি। গুনতে ভুল করেছে কী না সেটা ভেবে মন্তাজ মিয়া আরেকবার গুনতে শুরু করেছিল তার আগেই জরিনি খালা জালালকে হঠাৎ চিনে ফেলল, চিৎকার করে বলল, “আরে! তুই জালাইল্যা না?”
জালাল কিছু বলার আগেই মন্তাজ মিয়া লাফ দিয়ে এসে জালালের ঘাড় ধরে তাকে টেনে উপরে তুলে ফেলে একটা ঝাঁকুনি দিল। জালালের মনে হল তার সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।
জরিনি খালা হি হি করে হেসে বলল, “ওস্তাদরে মিস কল দে! বলতি হবি একটা শর্ট ছিল এখন আর শর্ট নাই। পুরা বিশজন ডেলিভারি দিবার পারমু। একটা বেকুবের বেকুব নিজে আইসা ধরা দিছে।”
জরিনি খালার হাসি আর থামতে চায় না।