জালাল পাইপ বেয়ে খুব সহজেই উপরের জানালা পর্যন্ত উঠে গেল। জানালা ভেতর থেকে বন্ধ, কাঁচ ভেঙেও লাভ নেই কারণ ভেতরে লোহার গ্রিল। জালাল তখন কার্নিশে পা দিয়ে সাবধানে এগিয়ে এসে বারান্দার দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে গেল। সামনে একটি ঘর, ভেতরে আলো জ্বলছে, মানুষ আছে কী নেই। বোঝা যাচ্ছিল না। জালাল খুব সাবধানে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিল। ছোট একটা ঘর, একটা টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার। একপাশে একটা পুরোনো আলমারি, দরজা খোলা, ভেতরে নানা ধরনের ময়লা আধা ময়লা জিনিসপত্র। মেঝেতে কয়েকটা কার্টন, একটা খোলা বাক্স। বাক্সে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না।
ঘরটায় কেউ নেই ব্যাপারটাতে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে জালাল যখন ভেতরে ঢুকতে যাবে ঠিক তখন পাশের একটা ঘরে পানি ফ্লাশ করার শব্দ হল আর একজন মানুষ তার প্যান্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে ঘরে ঢুকল। মানুষটা মাঝবয়সী, উঁচু কপাল, ভাঙা গাল, চোখ দুটি কোটরে ঢুকে আছে। চেয়ারে বসে সে কয়েকবার কাশল, তারপর ডাকল, “মন্তাজ মিয়া।”
মন্তাজ মিয়া নামের মানুষটা কাছাকাছি কোথাও ছিল সে পা ঘষতে ঘষতে ভেতরে এসে ঢুকল। মানুষটা কালো এবং মোটা, খাটো একটা লুঙি এবং লাল রঙের একটা গেঞ্জি পরে আছে। দুপুরবেলা জরিনি খালার সাথে সেও আটকে রাখা বাচ্চাগুলোকে ভয় দেখিয়ে এসেছিল।
মন্তাজ মিয়া তার বগল চুলকাতে চুলকাতে বলল, “ডাকছেন ওস্তাদ?”
“হ্যাঁ।” গালভাঙা মানুষটা বলল, “সবকিছু রেডি?”
“জে ওস্তাদ। ট্রাক রেডি। রাইতেই ডেলিভারি দিমু।”
“কেমনে নিবি?”
“ট্রাকের নিচে খড় বিছায়া দিছি। উপরে চট। সেইখানে সবগুলানরে শোয়াইয়া দিমু। উপরে তেরপল দিয়ে ঢাকা।”
“ট্রাক চালাইব কে?”
“কাদের।”
“হেল্পার?”
“মাজহার।”
“রাস্তা ঠিক আছে?”
“জে। রাস্তা ক্লিয়ার। তারপরেও ধরেন কাঁদেরের কাছে কিছু ক্যাশ টাকা থাকব। যদি ইমার্জেন্সি হয় পুলিশ-বিডিআর ঝামেলা করে তা হলে সাপ্লাই দিব।”
“গুড।” গালভাঙা মানুষটা সম্ভষ্টির ভান করে বলল, “ছেলেমেয়েগুলোরে ট্রাকে তুলবি কখন?”
“ধরেন রাত দশটার মাঝে রওনা দিমু। সবগুলারে বান্ধাবান্ধি করতে ধরেন বিশ মিনিট। তুলতে ধরেন আরো পনেরো মিনিট।”
জালাল খুব সাবধানে বুকের ভিতর থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়। এখন আর কোনো সন্দেহ নেই। মানুষগুলো আসলেই ছেলেধরা। জালাল বুকের ভিতর ভয়ের একটা কাঁপুনি অনুভব করে।
গালভাঙা মানুষটা কিছু একটা চিন্তা করল, বলল, “ঠিক আছে।” তারপর পকেট থেকে একটা ছোট কাঁচের শিশি বের করে টেবিলে রাখল। বলল, “এইটা হচ্ছে মার্কেটের সবচেয়ে ভালো মাল। এক ফোঁটা যদি খায় জোয়ান মানুষ টানা আটচল্লিশ ঘণ্টা ঘুমাবে। ছোট পোলাপানের জন্যে আধা ফোঁটা। মনে থাকবে?”
মন্তাজ মিয়া নামের কালো মোটা মানুষটা মাথা নাড়ল, “মনে থাকব। একজন আধা ফোঁটা, তার মানে দুইজনে এক ফোঁটা।”
“হ্যাঁ। আধা লিটারের পানির বোতলে দশ ফোঁটা মাল দিবি। ভালো করে ঝকাবি। তারপর সবাইরে দুই চামুচ করে খাওয়াবি।”
“ঠিক আছে ওস্তাদ।
“মনে রাখিস কিন্তু এই বোতলের মাল অসম্ভব কড়া। একটু বেশি হলে কিন্তু ফিনিস।”
“মনে থাকব ওস্তাদ। আপনি কুনো চিন্তা কইরেন না।”
ভাঙা গালের মানুষটা বলল, “এই যে এই শিশি এইখানে রাখলাম।”
জালাল দেখল শিশিটা টেবিলের উপর রেখেছে। ছোট কাঁচের একটা শিশি। ভেতরে স্বচ্ছ পানির মতো তরল ভয়ংকর ধরনের একটা ঘুমের ওষুধ!
এরকম সময়ে পাশের ঘর থেকে একজন মহিলা এসে ঢুকল। চেহারা দেখা যাচ্ছিল না বলে জালাল প্রথমে চিনতে পারেনি কথা বলতেই জালাল বুঝতে পারল, মহিলাটি হচ্ছে জরিনি খালা। জালাল শুনল জরিনি খালা বলছে, “ওস্তাদ, আমারে কিন্তু টাকা কম দিছেন।”
“টাকা কম দেই নাই।”
“আমি দুইটা মাইয়া আনছি। মাইয়ার রেট বেশি।”
“একটা বেশি ছোট।”
“ছোট হইছে তো কী হইছে? মাইয়া হইছে মাইয়া। দেখতে দেখতে বড় হইয়া যাইব।”
ভাঙা গালের ওস্তাদ বলল, “ছোট হইলে ঝামেলা বেশি। কাস্টমার নিতে চায় না।”
“তয় আমারে ফেরত দেন।”
“তুই কী করবি?”
“বগার কাছে বেচুম। বগা লুলা বানাইয়া বিক্রি করব।”
ওস্তাদ বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে তোকে না হয় আরও এক হাজার টাকা দিই।”
“দুই হাজার।”
“এক।”
“দুইয়ের এক পয়সা কম হলে হবি না। আপনি বলেন ওস্তাদ আমি কতোদিন থেকে আপনার জন্যে কাম করি।”
“ঠিক আছে দেড়। আর কথা বলিস না। নগদ দিয়ে দিচ্ছি।”
জরিনি খালা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে এইবার রাজি হলাম। সামনের বার কিন্তু রাজি হমু না।”
জালাল দেখতে পেল গালভাঙা ওস্তাদ পকেট থেকে একটা মানিব্যাগ বের করে সেখান থেকে কিছু টাকা বের করে জরিনির হাতে ধরিয়ে দিল, জরিনি টাকাগুলো গুনে নিজের কোমরে গুঁজে নিল।
গালভাঙা ওস্তাদ বলল, “যা, এখন মন্তাজের সাথে হাত লাগা। পোলা মাইয়াগুলানরে খাওয়া দিয়েছিস?”
“জে দুপুরে একবার দিছি। কেউ আর খাইতি চায় না। ভয় পাইছে তো। খালি কান্দে।”
“জোর করে খাওয়া-আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে কিন্তু খাওয়া নাই।”
“ঠিক আছে ওস্তাদ।”
গালভাঙা ওস্তাদ দাঁড়িয়ে বলল, “আয় দেখি, পোলা-মাইয়াগুলারে একটু দেখে আসি।”
“চলেন।”
তিনজন ঘর থেকে সামনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। হঠাৎ করে জালাল বুঝতে পারল, সে ছোট একজন মানুষ। কিন্তু তার উপর এখন অনেক বড় দায়িত্ব। তাকে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু সে কী করবে?