জরিনি খালার কথা শুনে মায়া দুই হাতে মুখ ঢেকে ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। মায়ার চিৎকারটা মনে হয় জরিনি খালাকে খুব আনন্দ দেয়। সে দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে থাকে।
জরিনি খালা একসময় হাসি থামাল তারপর সবার দিকে একনজর দেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। খাটো করে লুঙি আর লাল গেঞ্জি পরা মানুষটা জরিনি খালার পিছু পিছু বের হয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেল। ঘর ভর্তি বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোগো কপাল খুব ভালা। ইন্ডিয়াতে আমাগো মাল সাপ্লাই দিবার তারিখ পেরায় শেষ। হের লাগি তোগো আমরা ইন্ডিয়া পাঠামু। তোরা সব দিল্লি, বোম্বাই যাবি?”
মানুষটা বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, এর আগেরবার তোগো মতোন আরও দুই ডজন ছাওয়াল-মাইয়া আনছিলাম। তাগো কী করিছিলাম জানস?”
কেউ কোনো কথা বলল না। কালো মানুষটা হা হা করে হাসতে হাসতে বলল, “হাত-পা ভাইঙা লুলা বানাইছিলাম। ভিক্ষা করনের লাগি লুলার উপরে মাল নাই। চাইরজনের আবার ইস্পিশাল দাবাই দিছিলাম। কী দাবাই কইতে পারবি?”
বাচ্চাগুলোর কেউ কথা বলল না। লাল গেঞ্জি পরা কালো মোটা মানুষটা বলল, “চোখের মাঝে এসিড! এখন আন্ধা ফকির! গান গাতি গাতি ভিক্ষা করে–পেরতেক দিন তাগো কয় টাকা ইনকাম শুনলি তোদের জিব্বার মাঝে পানি চলে আসবি! তোরা কইবি আমি হমু আন্ধা ফকির! আমি হমু আমি আন্ধা ফকির!”
খুবই একটা হাসির কথা বলেছে এই রকম ভান করে মানুষটা হাসতে থাকে। তারপর হঠাৎ হাসি বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল, তারা শুনতে পেল, বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মায়া জেবার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আফা খিদা লাগছে।”
এরকম একটা সময়ে যে কারো খিদে লাগতে পারে জেবার বিশ্বাস হল না। সে কিছু না বলে মায়াকে ধরে রাখে–তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। সে কেমন করে এত বোকা হল? কেন সে একবারও জালালের কথা শুনল না? কেন সে বুঝতে পারল না জরিনি খালা একটা ভয়ংকর মহিলা?
১০-১২. চা-বিস্কুটের দোকান
চার তালা বিল্ডিংটার সামনে একটা চা-বিস্কুটের দোকান। জালাল সেই দোকানটার সামনে চুপচাপ বসে আছে। দুপুরবেলা সে একটা বনরুটি আর একটা কলা খেয়েছে। গরম ভাত খাওয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু সে বিল্ডিংটার সামনে থেকে নড়তে চাচ্ছিল না, তখন তাদেরকে অন্য কোথাও নিয়ে গেলে সেটা সে জানতে পারবে না। চার তালা বিল্ডিংয়ের কয় তালায় তাদেরকে রেখেছে জালাল প্রথমে বুঝতে পারেনি–কিন্তু উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে কয়েকবার জরিনি খালাকে দোতালার বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছে–সেখান থেকে আন্দাজ করতে পারছে যে মায়া আর জেবাও নিশ্চয়ই দোতালাতেই আছে। বিল্ডিংয়ের সামনে কোলাপসিবল গেট সেখানে বিশাল একটা তালা ঝুলছে তাই মনে হতে পারে ভেতরে ঢোকার বুঝি কোনো উপায় নেই। তবে জালাল চায়ের দোকানের সামনে বসে থেকেও ভেতরে ঢোকার আরো তিনটা পথ বের করে ফেলল। প্রথম পথটা হচ্ছে বিল্ডিংয়ের পাশের নারকেল গাছটা দিয়ে। এই গাছটা বেয়ে সে দোতালার কার্নিশে উঠে যেতে পারে। সেখান থেকে দোতালার বারান্দায়। দুই নম্বর পথটা হচ্ছে জানালাগুলো দিয়ে। জানালাগুলো নিচু, এই জানালায় পা দিয়ে সে উপরে উঠে যেতে পারবে, সেখান থেকে দোতালায়। এই জানালার থেকে আরো অনেক বিপজ্জনক জানালায় পা দিয়ে সে যখন খুশি তখন চলন্ত ট্রেনে উঠে যায় কাজেই তার জন্যে এটা পানির মতো সোজা। তিন নম্বর পথটা হচ্ছে পানির পাইপ। পাইপগুলো বেয়ে সে খুব সহজেই দোতালার জানালায় উঠে যেতে পারবে। জানালার কাঁচ ভেঙে ভেতরে ঢোকা খুব কঠিন হবার কথা নয়।
জালাল অবশ্যি তার কোনোটাই এখন করতে পারবে না। চারিদিকে দিনের আলো, এখন সে যদি বানরের মতো খিমচে খিমচে দোতালায় ওঠার চেষ্টা করে, তা হলে কারো না কারো চোখে পড়ে যাবে, তারপর যা একটা কাণ্ড হবে সেটা আর বলার মতো না।
কাজেই জালাল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে। অপেক্ষা করতে করতে সে দেখল এই বিল্ডিংয়ের মাঝে আরো একজন মহিলা আরো একটা বাচ্চার হাত ধরে ঢুকল। মহিলাটার চেহারা মোটেও জরিনি খালার মতো নয় কিন্তু তারপরেও কোথায় যেন দুজনের মাঝে একটা মিল রয়েছে। বাচ্চাটি একটা ছোট গরিব ধরনের ছেলে এবং তার সাথেও মায়ার কোথায় জানি একটা মিল আছে।
বিকেলবেলার দিকে জালাল দেখল বিল্ডিংয়ের সামনে রাখা ট্রাকটার ভেতরে একজন মানুষ এসে খড় বিছাতে শুরু করেছে। ট্রাকে করে যখন গরু নেয় তখন সেখানে এভাবে খড় বিছায়। বেশ পুরু করে খড় বিছিয়ে তার উপর চট বিছানো হল, তারপর পুরোটা একটা তেরপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল। খালি একটা ট্রাক তেরপল দিয়ে কেন ঢেকে দেওয়া হল জালাল সেটা বুঝতে পারল না।
অন্ধকার নামার পর জায়গাটা হঠাৎ করে কেমন যেন নির্জন হয়ে গেল। মনে হয় এলাকাটা ভালো না, লোকজন দিনের আলোয় সাহস করে যাওয়া-আসা করেছে, রাতেরবেলা আর সাহস পাচ্ছে না।
রাত একটু গম্ভীর হওয়ার পর জালাল ঠিক করল সে পাইপ বেয়ে বিল্ডিংটার দোতালায় উঠে যাবে। দোতালায় উঠে কী করবে সে এখনো জানে না। মানুষগুলো যদি ভালো হয় তা হলে পাইপ বেয়ে ওঠার অপরাধ নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবে। আর মানুষগুলো যদি খারাপ হয় তা হলে তাদের সামনে পড়া ঠিক হবে না। একনজর দেখেই আবার পাইপ বেয়ে নেমে যেতে হবে।