প্রথম প্রথম রিকশাটা একটু জোরে যাচ্ছিল, তার সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে জালাল প্রায় হাঁপিয়ে উঠছিল। একটু পরেই রিকশাটা আরো ছোট ঘিঞ্জি একটা গলিতে গিয়ে ঢুকল, রাস্তাটা খারাপ–তখন রিকশাটা আর জোরে যেতে পারছিল না, জালাল জোরে জোরে হেঁটেই রিকশার পিছনে পিছনে হেঁটে যেতে পারল।
ঘিঞ্জি রাস্তাটা দিয়ে মনে হয় পাশাপাশি দুটো রিকশাই যেতে পারে না–সেখানে একটা পুরোনো বিল্ডিংয়ের সামনে একটা বিশাল ট্রাক দাঁড়িয়েছিল। রিকশাটা সেখানে দাঁড়িয়ে গেল তখন জরিনি খালা রিকশা ভাড়া মিটিয়ে রিকশা থেকে নামল। কালো ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে মায়া আর জেবার হাত ধরে জরিনি খালা বিল্ডিংটার সামনে দাঁড়াল। বিল্ডিংয়ের মুখে একটা কোলাপসিবল গেট, ভেতরে একজন মানুষ টুলে বসে ছিল। জরিনি খালা মানুষটার সাথে নিচু গলায় কিছু একটা বলল, মানুষটা তখন গেটটা খুলে দেয়। জরিনি খালা মায়া আর জেবাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবার পর মানুষটা আবার গেটটা বন্ধ করে দিল।
বিল্ডিংয়ের ভেতরে জালাল ঢুকতে পারল না, ঢুকতে পারবে সেটা অবশ্যি সে আশাও করেনি। মায়া আর জেবাকে জরিনি খালা কোথায় নিয়ে আসতে চেয়েছে। জালাল শুধু সেটাই জানতে চেয়েছিল, সেটা সে এখন জেনে গেছে। হয়তো জরিনি খালা মায়া আর জেবাকে আসলেই নিজের মেয়ের মতো আদর করে, সেই জন্যে হয়তো এখানে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে তা হলে জালালের কিছুই করতে হবে না। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জালাল নিজের জায়গায় ফিরে যাবে।
জালাল নিজের মাকে বুঝিয়েছিল একজন মহিলা তাকে মায়ের মতো আদর করে। তার নিজের জন্যে না হয়ে মায়া আর জেবার জন্যে সেটা তো হতেও পারে! হয়তো সে মিছি মিছি সন্দেহ করে পিছু পিছু এতো দূর চলে এসেছে। আসলে হয়তো জেবা আর মায়া সত্যিকারের মায়ের মতো একটি মা পেয়ে গেছে।
হতেও তো পারে।
.
০৯.
জরিনি খালা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে দরজাটায় ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে একজন মোটা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কে?”
জরিনি খালা বলল, “আমি। আমি জরিনা।”
“ও। জরিনা সুন্দরী না কি?”
“হ। দরজা খুলো।”
খুট করে দরজা খুলে গেল। মায়া আর জেবা দেখল দরজার অন্য পাশে কালো মোষের মতো একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটা খাটো একটা লুঙি আর লাল রংয়ের একটা গেঞ্জি পরে আছে। মায়া আর জেবাকে দেখে মানুষটার চোখ দুটি চকচক করে ওঠে, জিব দিয়ে লোল টানার মতো শব্দ করে বলল, “জরিনা সুন্দরী! তুমি দেখি কামের মানুষ। দুইটা চিড়িয়া আনছ।”
জরিনা কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে জেবার বুকটা কেঁপে উঠল, তার মনে হল ভেতরে অনেক বড় বিপদ, মনে হল তার এখন এখান থেকে ছুটে পালাতে হবে কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। জরিনি খালা দুইজনকে দুই হাতে ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে এসেছে আর সাথে সাথে ঘটাং করে পিছনের দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
জরিনা দুইজনের হাত ধরে ভেতরের আরেকটা ঘরে নিয়ে গেল তখন পিছনের দরজাটা আবার বন্ধ করে দেওয়া হল।
জেবা ঘরের ভেতরে তাকাল এবং হঠাৎ ভয়ানকভাবে চমকে উঠল। ঘরের ভেতরে একটা খাট সেখানে একটা ময়লা বিছানা, একপাশে একটা ভাঙা ড্রেসিং টেবিল, একটা টেবিল, সেখানে কিছু খালি খাবারের প্যাকেট, কয়েকটা পানির বোতল। ঘরের একপাশে একটা আধখোলা দরজা সেখান থেকে বোটকা দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। জেবা অবশ্যি এসব দেখে চমকে উঠেনি, সে চমকে উঠেছে নিচের দিকে তাকিয়ে। মেঝেতে এবং দেয়ালে হেলান দিয়ে অনেকগুলো বাচ্চা চুপচাপ বসে আছে, বাচ্চাগুলোর চোখে-মুখে আতঙ্ক। বড় বড় চোখে তারা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
মায়াও চারিদিকে তাকাল, সেও একই দৃশ্যটা দেখল কিন্তু মনে হল সে কিছু বুঝতে পারল না। জরিনি খালার দিকে তাকিয়ে বলল, “জরিনি খালা, খিদা লাগছে।”
মনে হল কথাটা শুনে জরিনি খালার খুব মজা লেগেছে, সে হি হি করে হাসতে থাকে, মনে হয় হাসি থামতেই পারে না। মায়া বলল, “হাসছ কেন জরিনি খালা?”
জরিনি খালা বলল, “তোর কথা শুনে। কী খাবি? কোরমা-পোলাও না বিরানি?”
মায়া তখনো কিছু বুঝতে পারেনি, সরল মুখে বলল, “বিরানি।”
মায়ার কথা শুনে জরিনি খালা আবার হি হি করে হাসতে শুরু করে। তারপর যেভাবে হাসতে শুরু করেছিল ঠিক সেইভাবে হাসি থামিয়ে ফেলল এবং দেখতে দেখতে তার মুখটা পাথরের মতো থমথমে হয়ে ওঠে। খানিকক্ষণ সে মায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে এবং সেই দৃষ্টি দেখে মায়া ভয় পেয়ে যায়। মায়া ভাঙা গলায় বলল, “জরিনি খালা, তোমার কী হইছে? তুমি ডর দেখাও কেন?”
জরিনি খালা কিছু বলল না, স্থির চোখে মায়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মায়া বলল, “তুমি কইছিলা আমাগো নতুন জামা দিবা। বিরানি খাইতে দিবা-”
জরিনি খালা হঠাৎ হুংকার দিয়ে উঠে বলল, “চুপ কর আবাগীর বেটি। সখ দেইখা বাঁচি না-নতুন জামা লাগবি! বিরানি খাতি হবি! তোগো এখানে আনছি কীসের লাগি এখনো বুঝিস নাই?”
মায়া ফ্যাকাসে মুখে বলল, “কীসের লাগি?”
“তোগো বেচুম। ইন্ডিয়াতে বেচুম। কোরবানি ঈদের সময় গরু-ছাগল কেমনে বেচে দেখছস? হেই রকম!”
এই প্রথম মনে হল মায়া ব্যাপারটা বুঝতে পারল, আর্তচিৎকার করে বলল, “তুমি ছেলেধরা?”
“হ।” জরিনা খালা বুকের মাঝে থাবা দিয়ে বলল, “আমি ছেলেধরা। ছেলে আর মেয়ে ধরা। আমি তোগো ধরি আর কচমচ কইরা খাই! মাইনষে যেইভাবে মুরগির রান কচমচ কইরা খায় আমি হেইরকম তোগো ধইরা কচমচ কইরা খাই।”