স্টেশন থেকে বের হয়ে জরিনি খালা মোবাইল টেলিফোনে খানিকক্ষণ কথা বলল, তারপর আবার এগিয়ে গেল। প্লাটফর্মে রিকশা স্কুটার দাঁড়িয়ে আছে এখন যদি জরিনি খালা মায়া আর জেবাকে নিয়ে এগুলোতে উঠে যায় তা হলে জালাল কী করবে চিন্তা করে পেল না। তখন অন্য একটা রিকশা না হয় স্কুটারে উঠে তাকে বলতে হবে জরিনি খালাদের রিকশা বা স্কুটারের পিছু পিছু যেতে। তার কাছে মনে হয় রিকশা কিংবা স্কুটার ভাড়া হয়ে যাবে কিন্তু কেউ তার কথা শুনবে না। তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিবে।
জালালের কপাল ভালো জরিনি খালা রিকশা স্কুটারে উঠল না, মায়া আর জেবাকে নিয়ে সামনে হাঁটতে থাকে। মায়া আগে কখনো ঢাকা শহরে আসেনি তাই অবাক হয়ে এদিক-সেদিক তাকাতে তাকাতে জরিনি খালার হাত ধরে হাঁটতে থাকে।
হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা বাস স্টেশনে এসে দাঁড়াল, মনে হচ্ছে তিনজন এখান থেকে বাসে উঠবে। তিনজন উঠে যাবার পর জালাল একই বাসে উঠে যেতে পারে কিন্তু তাকে দেখে ফেললে সমস্যা হয়ে যাবে। চেষ্টা করতে হবে ভেতরে না ঢুকে দরজার কাছে ঝুলে থাকতে।
জরিনি খালা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাসগুলো লক্ষ করে। প্রথম কয়েকটি বাসের নম্বর দেখে সে সেগুলোতে ওঠার চেষ্টা করল না। তখন একেবারে ভাঙাচুরা একটা বাস এসে দাঁড়াল, হেলপার নেমে ফকিরাপুল, ফার্মগেট, কাকলী, উত্তরা, টঙ্গী বলে চিৎকার করতে থাকে তখন জরিনি খালা মায়ার হাত ধরে সেই বাসে উঠে পড়ে। তাদের পিছু পিছু জেবাও বাসে উঠে পড়ল। জালাল লোকজনকে আড়াল করে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইল, ঠিক যখন প্যাসঞ্জার বোঝাই করে বাসটা ছেড়ে দিল তখন জালাল লাফিয়ে বাসটাতে উঠতে গেল। কিন্তু হেলপার ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল, বাসে উঠতে দিল না। তার চেহারা পোশাক দেখে হেলপারের মনে হয়েছে সে নিশ্চয়ই বাসে উঠে ভাড়া দিতে পারবে না।
বাসটা চলেই যাচ্ছিল এবং জালাল প্রায় হাল ছেড়েই দিচ্ছিল তখন বাসের পিছনে বাম্পারটা তার চোখে পড়ল। লাফ দিয়ে সে বাম্পারটাতে উঠে দাঁড়িয়ে যেতে পারে, বাম্পার থেকে সে যেন পড়ে না যায় সেই জন্যে কিছু একটা হাত দিয়ে ধরে রাখতে হবে, ধরার সেরকম কিছু নেই-তবে ভাঙা ব্যাকলাইটটা কষ্ট করে ধরে রেখে মনে হয় সে ঝুলে থাকতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা বাসের পিছনে কোনো জানালা নেই সে যে এখানে ঝুলে আছে কেউ টের পাবে না।
জালাল চিন্তা করে সময় নষ্ট করল না, দৌড়ে গিয়ে বাসটার বাম্পারের উপর দাঁড়িয়ে গেল। আরেকটু হলে পড়েই যাচ্ছিল, কোনোমতে ভাঙা ব্যাকলাইটটা ধরে সে তাল সামলে নিল।
ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে বাসটা ছুটতে থাকে, পিছনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা হেলপারটা বাসের গায়ে থাবা দিয়ে চিৎকার করে আশেপাশের গাড়ি, টেম্পু, স্কুটারকে সরিয়ে দিতে থাকে। সে জানতেও পারল না, খুবই কাছাকাছি বিপজ্জনকভাবে বাম্পারে দাঁড়িয়ে জালাল এই বাসে করেই যাচ্ছে। তাকে উঠতে দিলে বাস ভাড়াটা পেত, এখন সেটাও পাবে না।
প্রত্যেকবার বাসটা থামার আগেই জালাল বাম্পার থেকে নেমে একটু দূরে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল, কে উঠছে সেটা নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই কিন্তু জরিনি খালা মায়া আর জেবাকে নিয়ে নামছে কি না সে দেখতে চায়। বাসটা ছেড়ে দিতেই আবার সে দৌড়ে গিয়ে বাম্পারের উপর দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল-দেখে মনে হতে পারে এটা খুবই বিপজ্জনক কাজ কিন্তু জালালের কাছে এটা ছিল খুবই সহজ একটা ব্যাপার। এর চাইতে অনেক বেশি বিপজ্জনক কাজ সে খুব সহজে করে ফেলতে পারে। জালাল জানে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে না দিলে কোনোদিনও সে এখান থেকে পড়ে যাবে না।
টঙ্গির কাছাকাছি জরিনি খালা মায়া আর জেবাকে নিয়ে বাস থেকে নেমে এদিক-সেদিক তাকাল। জালাল একটু দূরে মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জরিনি খালা একটু এগিয়ে গিয়ে আবার তার মোবাইল টেলিফোনটাতে কিছুক্ষণ কথা বলল, কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হল কোনো কারণে সে রেগে গেছে। কথা বলা বন্ধ করে সে এবারে জোরে জোরে হাঁটতে থাকে, মায়াকে মাঝে মাঝে হ্যাঁচকা টান দেয়, মায়া জরিনি খালার সাথে তাল মিলানোর চেষ্টা করে, আরো জোরে হাঁটার চেষ্টা করে।
খানিকদূর গিয়ে জরিনি খালা রাস্তা পার হল–বাস, গাড়ি, টেম্পুর ফাঁকে ফাঁকে হেঁটে হেঁটে জরিনি খালা খুব সহজেই ব্যস্ত রাস্তাটা পার হয়ে যায়। রাস্তা পার হয়ে তারা কোনোদিকে যাচ্ছে জালাল লক্ষ করল তারপর সেও রাস্তা পার হয়ে এলো।
জরিনি খালা বড় রাস্তা থেকে একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে একটা রিকশা ভাড়া করে মায়া আর জেবাকে নিয়ে সেটাতে উঠে পড়ল। জালাল এবারে একটু বিপদে পড়ে যায়–সে ইচ্ছে করলে আরেকটা রিকশা ভাড়া করতে পারে কিন্তু রিকশাওয়ালাকে সে কী বলবে? কোথায় যাবে? আর ততক্ষণে জরিনি খালা অনেকদূর চলে যাবে–পরে খুঁজেও পাবে না।
তার থেকে মনে হয় রিকশাটার পিছনে পিছনে দৌড়ে যাওয়া সহজ। রাস্তাটা ছোট, আঁকাবাঁকা গলি, কাজেই রিকশাটা খুব জোরে যেতে পারবে না। সে ইচ্ছা করলে মনে হয় একটা রিকশার সাথে দৌড়াতে পারবে। চিন্তা করার খুব সময় নেই তাই সে আর দেরি না করে জরিনি খালার রিকশাটাকে চোখে চোখে রেখে পিছন পিছন দৌড়াতে থাকে।