প্যাসেঞ্জাররা চলে যাবার পর প্লাটফর্মটা একটু ফাঁকা হল। তবে স্টেশনের মজা হচ্ছে এটা কখনোই পুরোপুরি ফাঁকা হয় না। একটা ট্রেন যখন আসে কিংবা ছাড়ে তখন হঠাৎ করে স্টেশনে অনেক মানুষের ভিড় হয়ে যায়। ট্রেনটা চলে যাবার পর ভিড় কমে গেলেও অনেক মানুষ থাকে। পত্রিকার হকার, ঝালমুড়িওয়ালা, অন্ধ ফকির, দুই চারজন পাগল, স্টেশনের লোজন, কাজকর্ম নেই এরকম পাবলিক। এই মানুষগুলোর মাঝে অবশ্যি প্যাসেঞ্জারদের ছটফটানি ভাবটা থাকে না। তারা শান্তভাবে এখানে সেখানে বসে থাকে না হয় হাঁটাহাঁটি, করে।
জালাল পকেটে চকচকে দুইটা নোট নিয়ে পাটফর্মে ঢুকল। গেটের কাছে হঠাৎ একটা মানুষ তাকে থামাল, “এই পিচ্চি-এইখানে বাথরুম কোনদিকে?”
মানুষটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে অবস্থা বেশি ভালো না–এখনই বাথরুমে না গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে। দোতলায় ভদ্রলোকদের বাথরুম, নিচে ডান দিকে পুরুষদের, বাম দিকে মেয়েদের, সোজা সামনে গেলে গরিব মানুষের ময়লা বাথরুম। জালাল তার কোনোটা না দেখিয়ে একেবারে উল্টো দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “হুই যে হেই দিকে।”
মানুষটা জালালের কথা বিশ্বাস করে লম্বা লম্বা পা ফেলে সেদিকে হাঁটতে থাকে। জালাল দাঁত বের করে হাসতে হাসতে তাকিয়ে দেখে মানুষটা এখন প্রায় দৌড়াচ্ছে। কোনো বাথরুম খুঁজে না পেয়ে তার কী অবস্থা হবে চিন্তা করে তার মুখের হাসিটা প্রায় দুই কান ছুঁয়ে ফেলল।
জালাল প্লাটফর্মে ঢুকে এদিক-সেদিক তাকিয়ে অন্যদের একটু খোঁজ নিল। তারপর এক কোনায় জড়ো করে রাখা অনেকগুলো বড় বড় বস্তার একটার উপর হেলান দিয়ে বসল। বস্তার মাঝে কী আছে কে জানে, আশেপাশে একটু বোটকা গন্ধ, কিছুক্ষণের মাঝেই অবশ্যি জালাল গন্ধটার কথা ভুলে গেল। জালালকে দেখে একটু পর অন্য বাচ্চাগুলোও আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে যায়। এই ট্রেনটা থেকে কার কী আয়-রোজগার হয়েছে সেটা নিয়ে নিজেরা একটু কথাবার্তা বলল। মায়া তার হাতে মুঠি করে রাখা ময়লা নোটগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখে, সে এখনো গুনতে শিখে নাই তাই দেখে একটা আন্দাজ করতে হয়। জালাল জিজ্ঞেস করল, “কয় টাকা পাইলি?”
“জানি না।”
“আমারে দে, গুইনা দেই।”
মায়া মুখ বাঁকা করে বলল, “ইহ্!” তার এই মূল্যবান রোজগার আর কারো হাতে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
জালাল সরল মুখ করে বলল, “আমি নিমু না। আল্লার কসম খোদার কিরা।”
মায়া ভুরু কুঁচকে তাকাল, জালাল সত্যি সত্যি বলছে না কী তার কোনো বদ মতলব আছে বুঝতে পারছে না।
মজিদ বলল, “দিস না মায়া। জালাল তোর টেহা গাপ কইরা দিব।”
জালাল বলল, “গাপ করুম না। খোদার কসম।”
মায়া তার পরেও জালালকে বিশ্বাস করল না, নিজেই টাকাগুলো গোনার চেষ্টা করতে লাগল। সে সব নোট চিনে না কিন্তু প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে ভিক্ষে করে সে এক দুই টাকার নোট আর খুচরা পয়সা ছাড়া কিছু পায় না, তাই গোনার বিশেষ কিছু থাকেও না।
মায়া তার ফোকলা দাঁত দিয়ে বাতাস বের করে বলল, “কেউ টেহা দিবার চায় না।”
মজিদ বলল, “কেন তোরে দিব? হেরা কি তোর জন্যি টেহা কামাই করে?”
জালাল মায়াকে উপদেশ দিল, “যখন টাকা চাইবি তখন হাসবি না। মুখটা কান্দা কান্দা করে রাখবি।”
মায়া বলল, “রাখি তো।”
“গায়ে হাত দিবি। পা ধরে রাখবি।”
“রাখি তো।”
“যতক্ষণ টাকা না দেয় ছাড়বি না।”
“ছাড়ি না তো।”
মজিদ বস্তায় শুয়ে ছিল হঠাৎ সোজা হয়ে বসে দুই নম্বর প্লাটফর্মের দিকে তাকিয়ে, চিৎকার করে ডাকল, “কাউলা। হেই কাউলা।”
সবাই দুই নম্বর প্লাটফর্মের দিকে তাকায়, সেখানে তিন চার বছরের একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে–তার গায়ে কোনো কাপড় নেই। কখনো থাকে না। কাউলা তার নাম নয়, সত্যি কথা বলতে কী তার আসলে কোনো নাম নেই, গায়ের রং কুচকুচে কালো বলে তাকে কাউলা বলে ডাকে। জেবার ধারণা কাউলার গায়ের রং আসলে কালো নয়–শরীরে ময়লা জমতে জমতে তার গায়ের রং এরকম কুচকুচে কালো হয়েছে!
মজিদ আবার চিৎকার করে বলল, “হেই কাউলা! তোর মা কই?”
অন্যেরাও তার সাথে যোগ দিল, “তোর মা কই? মা কই?”
কাউলা তাদের কথা বুঝতে পারল কি না বোঝা গেল না। তাকে কেউ কথা বলতে শুনেনি, সে কথা বলতে পারে কি না সেটাও কেউ জানে না। কেউ কিছু বললে সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। এবারেও সে দুই নম্বর প্লাটফর্ম থেকে তাদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।
জেবা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “তোর পাগলি মা কই?”
কথা শেষ হবার আগেই কাউলার মাকে দেখা গেল। শুকনো খিটখিটে একজন মহিলা দেখে বয়স আন্দাজ করা যায় না। রুক্ষ মাথার চুলে জটা, শরীরে ময়লা কাপড়। মাথায় নিশ্চয়ই উকুন কিলবিল কিলবিল করছে, এক হাতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে হাঁটছে।
মজিদ চিৎকার করে ডাকল, “পাগলি! এই পাগলি।”
মহিলাটা তাদের চিৎকারে কান দিল না, বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলতে বলতে হেঁটে যেতে থাকে।
শাহজাহান গলা উঁচিয়ে বলল, “এই পাগলি! তোর পাগলা কই?”
শাহজাহানের কথায় সবাই মজা পেয়ে গেল, তখন সবাই গলা উঁচিয়ে বলতে লাগল, “এই পাগলি! তোর পাগলা কই?”
মহিলাটা হঠাৎ দুই হাত আঁকাতে ঝাঁকাতে মাথা নাড়তে থাকে এবং সেটা দেখে সবাই হি হি করে হাসতে থাকে। পাগল মানুষের বিচিত্র কাজ দেখে তারা খুব মজা পায়।