তো আর প্যাসেঞ্জারদের জানার দরকার নেই। জালাল মুখ আরো কাচুমাচু করে বলল, “ব্যাগটা নিয়া দেই? পেটে খিদা একটু ভাত খামু।”
মানুষটার নরম ধরনের মুখটা এক সেকেন্ডে কেমন যেন হিংস্র হয়ে যায়, জালালের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠল, “ভাগ হারামজাদা। কথা কানে যায় না?”
জালাল মনে মনে বলল, “তুই হারামজাদা!” তারপর এই মানুষটার পিছনে আর সময় নষ্ট করল না। ভালো মানুষ ধরনের অন্য একজনের কাছে গিয়ে তার পেট মোটা ব্যাগটা ধরে বলল, “স্যার ব্যাগটা নামায়া দেই?”
মানুষটার চেহারাই শুধু ভালো মানুষের মতো–আসলে সে মহা বদ। সে জালালের দিকে তাকালই না, কথাটা শুনেছে সেরকম ভান পর্যন্ত করল না। কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাব করে দাঁড়িয়ে রইল। এই প্যাসেঞ্জারের পিছনে সময় নষ্ট করে লাভ নাই জানার পরও জালাল শেষ চেষ্টা করল, ডান হাতটা বুকের কাছে আড়াআড়িভাবে ধরে মাথাটা একটুখানি বাঁকা করে মুখের মাঝে একটু দুঃখ দুঃখ ভাব ফুটিয়ে বলল, “স্যার! ব্যাগটা নামায়া দেই। পেটে ভুখ। একটু ভাত খামু।”
মানুষটা একটু হাই তুলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল যেন জালাল আশেপাশে আছে, কিছু একটা বলছে সেটা সে লক্ষ পর্যন্ত করেনি। জালাল আর সময় নষ্ট করল না, মনে মনে মানুষটাকে একটা গালি দিয়ে সামনের দিকে দৌড়ে গেল।
ট্রেনটা এতোক্ষণে থেমে গেছে, সবাই উঠে দাঁড়িয়ে উপর থেকে মালপত্র নামানো শুরু করেছে। বগির মাঝামাঝি একটা মেয়ে তার ব্যাগগুলো হাতে তোলার চেষ্টা করছে। জালাল কাছে গিয়ে বলল, “আফা আপনার ব্যাগটা নিয়া দেই?”
মেয়েটা ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি কেমন করে ব্যাগ নিবে? এতো ছোট মানুষ!”
মেয়েটার কথা, গলার স্বর, বলার ভঙ্গি শুনেই জালাল বুঝে গেল এই মেয়েটাকে সে নরম করে ফেলতে পারবে। হাতটা বুকের কাছে এনে মুখের মাঝে দুঃখি দুঃখি একটা ভাব ফুটিয়ে বলল, “সারাদিন কিছু খাই নাই আফা! পেটের মাঝে ভুখ–একটু ভাত খাবার চাচ্ছিলাম।”
মেয়েটা জালালের মুখের দিকে তাকায়, এটা খুবই ভালো লক্ষণ। যাদের মন নরম তারা মুখের দিকে তাকায়, চোখের দিকে তাকায়। যারা বদ টাইপের লোক তারা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে–কথা না শোনার ভান করে। জালাল গলার স্বরটা আরো দুঃখি দুঃখি করে বলল, “দেন আফা! ব্যাগটা নিয়া দেই।”
“কত নেবে?”
.
আনন্দে জালালের বুকের মাঝে রক্ত ছলাৎ করে উঠল কিন্তু সে মুখে কিছুই বলল না। মুখটা আরো দুঃখি দুঃখি করে বলল, “আপনি যা দিবেন তাই”
“উঁহু। কত দিতে হবে আগে থেকে বল।”
জালাল কোনো কথা না বলে টান দিয়ে একটা ব্যাগ মাথায় তুলে নিয়ে বলল, “আপনি খুশি হয়ে যা দিবেন তাই আফা!”
মেয়েটা হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “চল।”
জালালের মুখে হাসি ফুটে উঠল এবং এইবারে সে এটা লুকানোর চেষ্টা করল। এই মেয়েটা এখন তাকে যতই দিতে চাইবে সে ভান করবে সেটা কম আর আরো বেশি দেওয়ার জন্যে সে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকবে। পৃথিবীতে এই মেয়েটার মতো সহজ সরল দুই চারজন মানুষ আছে বলেই সে মাঝে মধ্যে দুই চারটা টাকা বেশি রোজগার করতে পারে।
ট্রেন থেকে নেমে ব্যাগটা মাথায় নিয়ে সে মেয়েটার সামনে সামনে হাঁটতে থাকে। চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখল মজিদ এখনো কারো ব্যাগ নিতে পারেনি, মুখ কাচুমাচু করে পাটফর্মে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। গাধাটা ফাস্ট ক্লাশে উঠেছিল! ফার্স্ট ক্লাশের প্যাসেঞ্জারদের ব্যাগ নেওয়ার জন্যে নিজেদের লোকজন থাকে। যদি নিজেদের লোকজন না থাকে তা হলে ব্যাগের নিচে চাকা লাগানো থাকে তারা সেই চাকা লাগানো ব্যাগ টেনে টেনে নিয়ে যায়। গরিব মানুষের পেটের ভাত মারার জন্যে কত রকম কায়দা কানুন সেটা দেখে জালাল মাঝে মাঝে তাজ্জব হয়ে যায়।
ব্যাগটা তুলে দেবার পর মেয়েটা তাকে পাঁচ টাকার একটা নোট দিল। হালকা একটা ব্যাগ যেটা মেয়েটা নিজেই নিয়ে আসতে পারত তার জন্যে পাঁচ টাকার বেশি দেওয়ার কথা না। কিন্তু জালাল হতভম্ব হয়ে যাবার একটা ভঙ্গি করল। মুখের এমন একটা ভঙ্গি করল যেন মেয়েটা তার মুখে একটা চড় দিয়ে ফেলেছে। চোখ কপালে তুলে বলল, “এইটা কী দিলেন আফা?”
“কেন কী হয়েছে?” মেয়েটা ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি না বললে আমি খুশি হয়ে যা দিতে চাই দিব।”
“তাই বইলা এতো কম?”
”আমি বলেছিলাম আগে থেকে বল–”
“আপনার সাথে আমি দরদাম করমু? ভাত খাওয়ার জন্যে একটু টাকা দিবেন না?”
“যাও-যাও বিরক্ত করো না! এইটুকুন একটা ব্যাগের জন্যে পাঁচ টাকাই বেশি। টাকা গাছে ধরে না।”
জালাল চোখে-মুখে একটা আহত ভাব ফুটিয়ে বলল, “আফা-আজকাল পাঁচ টাকা কেউ ফকিরকেও ভিক্ষা দেয় না। আমি কি ফকির?”
মেয়েটা অসম্ভব বিরক্ত হয়ে জালালের দিকে তাকাল। জালাল পাঁচ টাকার নোটটা মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আফা, আপনার টাকা আমার লাগত না। নেন–”
মেয়েটা মনে হয় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে জালালের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর ব্যাগ থেকে আরো একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে জালালের দিকে প্রায় ছুঁড়ে দিয়ে স্কুটারে ঢুকে গেল।
স্কুটারটা চলে না যাওয়া পর্যন্ত মুখে একটা আহত ভাব ফুটিয়ে জালাল দাঁড়িয়ে রইল। স্কুটারটা চলে যাবার পর সে নোট দুইটাতে চুমু খেয়ে তার বুক পকেটে রেখে দেয়। আজকের দিনটা এখন পর্যন্ত মোটামুটি ভালোই যাচ্ছে–সারাটা দিন এইভাবে গেলে খারাপ হয় না।