“তুমি নিজে শুরু করবা?”
“হ্যাঁ।”
“কার কাছে বেচবা?”
“পাবলিকের কাছে। হেরোইনখোরের কাছে।”
জালাল অবাক হয়ে সবুজের দিকে তাকিয়ে রইল। তারা যখন স্টেশনের প্লাটফর্মে ঘুমায় তখন তাদের সবচেয়ে বড় বড় বিপদ দুই জায়গা থেকে আসে, এক হচ্ছে পুলিশ আর দুই হচ্ছে হেরোইনখোর। যখনই তারা ক্ষ্যাপা কোনো মানুষ দেখে ধরেই নেয় সেই মানুষগুলো হচ্ছে হেরোইনখোর। সবুজ সেই হেরোইনখোরদের কাছে হেরোইনের ব্যবসা করবে শুনে জালালের হাত-পা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
সবুজ তার সিগারেটে টান দিয়ে নাক দিয়ে ধোয়া ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলি জালাইল্যা, হেরোইন হইল গিয়া সোনার থেকে দামি–এই মনে কর এক কাপ হেরোইনের পাইকারি দাম হচ্ছে কম পক্ষে পাঁচ লাখ টাকা। খুচরা আরো বেশি।”
“তোমার কাছে কয় কাপ আছে?”
সবুজ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সিগারেটে আবার টান দিল। বলল, “তুই করবি বিজনেস?”
“ভাই, ডর করে।”
“ডরের কী আছে। আমি আছি না। তুই পয়লা আমার সাথে থাকবি তারপরে নিজে নিজে করবি।”
জালাল কিছু বলল না, হেরোইনখোরদের নিয়ে সে যত ভয়ংকর গল্প শুনেছে সেগুলো জেনে শুনে তার এই বিজনেসে যাবার কোনো ইচ্ছা নেই। কিন্তু সবুজকে সেটা বলতেও তার সাহস হল না। তাকে বিশ্বাস করে সবুজ সব কথা বলেছে এখন সেখান থেকে পিছিয়ে যাওয়া রীতিমতো বিশ্বাসঘাতকের কাজ হবে।
.
সবুজ আবার কয়েকদিনের জন্যে উধাও হয়ে গেল। কয়েকদিন পর আবার যখন স্টেশনে ফিরে এসেছে তখন তার চেহারা আরো খোলতাই হয়েছে। টি-শার্টের উপর গোলাপি একটা শার্ট, শুধু তাই না, বাম হাতে একটা ঘড়ি। এবারে অবশ্যি সবুজকে আগেরবারের মতো নিজেকে জাহির করতে দেখা গেল না, কথাবার্তা বলল কম আর তাকে কেমন জানি চিন্তিত দেখাল।
জালাল একদিন সবুজকে আবিষ্কার করল গোডাউনের পিছনে। এমনিতে সেখানে কেউ যায় না, জায়গাটা নির্জন একটু অন্ধকার। জালাল যখন মাঝে মাঝে তার গোপন টাকা গুনতে চায় এখানে এসে গুনে যেন কেউ দেখতে না পায়। সেখানে সবুজকে দেখে জালাল যেরকম চমকে উঠল, জালালকে দেখে সবুজও সেরকমভাবে চমকে উঠল। সবুজ জালালকে ধমক দিয়ে বলল, “কী করস এইখানে?”
জালালের মনে হল সেও সবুজকে একই প্রশ্ন করতে পারে কিন্তু সাহস করল না। আমতা আমতা করে বলল–”সকালবেলা ডাইলপুরি খাইছিলাম, বাসি মনে হয়। পেটের মাঝে মোচড় দিছে তাই এইখানে আসছিলাম ইয়ে করতে–”
খুবই বিশ্বাসযোগ্য কথা, নিরিবিলি জায়গা বলে অনেকেই এখানে”ইয়ে” করতে আসে, সবসময়ই এখানে চাপা দুর্গন্ধ। সবুজ জালালের কথা বিশ্বাস করল তখন জালাল জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী কর এইখানে?”
“এই তো–” বলে হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে সবুজ হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে একবার পিছন ফিরে দেখল তারপর গোডাউনের পিছন থেকে বের হয়ে গেল। জালাল কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর তার প্যান্টের শেলাইটা খুলে সেখান থেকে তার দুমড়ানো-মমাচড়ানো নোটগুলো বের করে গুনতে শুরু করে।
.
রাত্রিবেলা সবাই দুই নম্বর প্লাটফর্মে শুয়েছে। এখন কোন মাস কে জানে একটু একটু শীত পড়তে শুরু করেছে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ির মাঝে থাকে তাই শোয়ার সাথে সাথে সবার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। জালাল ঘুমিয়েই ছিল হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল, কুক্কু তার কাপড় কামড়ে ধরে তাকে টানছে।
জালাল চোখ খুলতেই কুক্কু চাপা স্বরে ডাকল, কেমন যেন ভয়ার্ত একটা ডাক, লেজটা নোয়ানো কান দুটো পিছনে, দেখে মনে হয় কিছু একটা দেখে কুক্কু ভয় পেয়েছে। জালাল ঘুম ঘুম চোখে কুক্কুকে কাছে টেনে এনে পাশে শুইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল, কুক্কু শুতে চাইল না, চাপাস্বরে গরগর করে শব্দ করল তারপর লেজ নামিয়ে জালালের চারপাশে হাঁটতে থাকে, পা দিয়ে মাটি আচড়ায়। জালাল বুঝতে পারল কুক্কু তাকে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছে, কিন্তু মানুষের মতো কথা বলতে পারে না বলে বলতে পারছে না। জালাল উঠে বসে বলল, “কী হইছে?”
কুক্কু কয়েক পা হেঁটে গেল তারপর দূরে তাকিয়ে থেকে মাথা উঁচু করে ঘেউ ঘেউ করে ডাকল। তারপর হঠাৎ করে মাথা নামিয়ে জালালের কাছে ফিরে এল। আকারে-ইঙ্গিতে আবার কিছু বলার চেষ্টা করছে। জালাল মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করল, “গুলমাল?”
কুক্কু মাথা নেড়ে কুঁই কুঁই শব্দ করল, যার অর্থ যা কিছু হতে পারে। জালাল বলল, “আমি যামু তোর লগে?”
কুক্কু আবার মাথা নিচু করে চাপা ভয়ের শব্দ করল। জালাল তখন হাল ছেড়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। কুক্কু কিছু একটা বলতে চাইছে, ব্যাপারটা মনে হয় খারাপ কিন্তু তার আর কিছু করার নেই। ব্যাপারটা কী হতে পারে চিন্তা করতে করতে জালাল ঘুমিয়ে গেল। কুক্কু অবশ্যি ঘুমাল না। দুই পায়ের মাঝখানে মাথা রেখে বসে রইল। একটু পর পর চাপা স্বরে ভয়ার্ত একটা শব্দ করতে লাগল।
ভোরে মায়ার চিৎকারে জালালের ঘুম ভেঙে গেল, মায়া রেল লাইন ধরে ছুটতে ছুটতে আসছে, তার চোখে-মুখে অবর্ণনীয় আতংক। তার ফোকলা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাতাস বের করে চিৎকার করতে করতে আসছে, কী বলছে কেউ বুঝতে পারছে না। সে ভয়ে ঠিক করে কথা বলতেও পারছিল না, আতঙ্কের এক ধরনের শব্দ ছাড়া মুখ থেকে আর কিছু বের হচ্ছে না। জেবা ছুটে গিয়ে মায়াকে ধরে জিজ্ঞেস করল, “কী হইছে?”