জালাল বিষয়টা ঠিক বুঝল না, ভুরু কুঁচকে বলল, “বাতাসে টেহা উড়ে?”
“হ।“
“তুমি হেই টেহা ধর আর পকেটে ঢুকাও?”
সবুজ মাথা নাড়ল। জালাল বলল, “আমারে দেহাও টেহা কোনখানে উড়ে আমিও ঢুকাই।”
“দেখবার চাস?”
জালাল মাথা নাড়ল, বলল, “হ।”
“ঠিক আছে তুই যদি দেখবার চাস তা হইলে তোরে দেখামু। তোরে শিখামু কিন্তুক তুই সেইটা কাউরে কইতে পারবি না।”
জালাল মাথা নাড়ল, বলল, “কমু না।”
“খোদার কসম?”
“খোদার কসম।”
“আল্লাহর কিরা?”
“আল্লাহর কিরা।”
কেমন করে বাতাসে উড়তে থাকা টাকা ধরতে হয় সবুজ তখনই সেটা বলতে শুরু করতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখন মায়া আর জেবা এসে হাজির হল বলে বলতে পারল না। জেবা অবাক হয়ে বলল, “সবুজ বাই! তুমারে দেহি ইস্কুলের ছাত্রের মতো লাগে!”
মায়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল তারপর সাবধানে সবুজের শার্টটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বলল, “তুন সাট!”
সবুজ মায়ার হাত সরিয়ে বলল, “হাত সরা, ময়লা হাত দিয়া ধরবি না।”
জেবা হি হি করে হেসে বলল, “লতুন বড়লোক।”
সবুজ চোখ পাকিয়ে বলল, “ঢং করবি না।”
জেবা ছোট বড় মানে না, হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “বাই, ইস্কুল ছাত্রের কাপড় কোন বাড়ি থাইকা চুরি করছ?”
“চুরি করমু কেন? কিনছি।”
“কিনতে তো টেহা লাগে। তুমার টেহা আছে?”
“তুই কী মনে করস? আমার টেহা নাই?”
জেবা মাথা নাড়ল, বলল, “থাকনের কথা না!”
সবুজ তখন প্যান্টের পিছন থেকে একটা মানিব্যাগ বের করে জেবাকে খুলে দেখাল, ভেতরে অনেকগুলো নোট। জেবা মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝছি।”
“কী বুঝছস?”
“তুমি পকেট মাইরের ইস্কুলে ভর্তি হইছ। তুমি মাইনসের পকেট মার।”
“মারলে মারি। তোর সমিস্যা কী?”
“আমার কোনো সমিস্যা নাই। সমিস্যা তোমার। যেদিন ধরা খাইবা সেইদিন তোমারে পিটায়া মাইরা ফেলব। সাপরে যেইরকম মাইনসে পিটায়া মারে হেইভাবে।”
সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তাদের সবার চোখের সামনে কয়েক মাস আগে এই স্টেশনে একজন পকেটমারকে পাবলিক পিটিয়ে শেষ করে দিয়েছিল। পুলিশ এসে কোনোভাবে পকেটমারটাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেছে, মানুষটা বেঁচে গেছে না মরে গেছে তারা জানে না।
সবুজ মুখ শক্ত করে বলল, “আমি পকেট মারি না।”
“তয় মানিব্যাগ কই পাইছ।”
“কিনছি।”
“টেহা কই পাইছ?”
“রোজগার করছি।”
“কেমনে? তুমি কী জজ-বেরিস্টরের চাকরি কর?” কথা শেষ করে জেবা হি হি করে হাসতে থাকে।
সবুজ চোখ পাকিয়ে জেবার দিকে তাকিয়ে তাকে একটা খারাপ গালি দিল। জেবা গালিটা গায়ে মাখল না, মায়াকে বলল, “আয় মায়া যাই।”
মায়া সবুজের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমার এতো টেহা। আমরারে বিরানী খাওয়াও।”
সবুজ বলল, “যা ভাগ।”
“তা হইলে ঝাল মুড়ি খাওয়াও।”
“ভাগ। না হইলে মাইর দিমু।”
মায়া জিব বের করে সবুজকে একটা ভেংচি দিয়ে হেঁটে চলে গেল। সবুজ তার সিগারেটে আরো একটা টান দিয়ে আরেকবার কেশে উঠে সিগারেটটা জালালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নে। খা।”
জালাল মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ্।”
সবুজ তখন শুকনো মুখে সিগারেটটা হাতে নিয়ে অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে আবার সিগারেটটাতে টান দেয়।
জালাল বলল, “বাই। তুমি টেহা উড়ার কথা বইলতে চাইছিলে।”
সবুজ গম্ভীর মুখে বলল, “কমু। কিন্তুক সাবধান।”
“ঠিক আছে। সাবধান।”
.
সবুজ আকাশে টাকা উড়ার বিষয়টা জালালকে বলল দুইদিন পর। সেটা বলার জন্যে জালালকে অবশ্যি সবুজের পিছন পিছন রেল লাইন ধরে অনেক দূর হেঁটে যেতে হল। শহরের বাইরে একটা নিরিবিলি জায়গায় কালভার্টের উপর বসে সবুজ বিষয়টা জালালকে বোঝাল। শহরে হেরোইন ব্যবসায়ী আছে, সবুজ তাদের হেরোইন আনা-নেওয়ার কাজে সাহায্য করে–এই কাজে অনেক টাকা।
জালাল জানতে চাইল, কেমন করে আনা-নেওয়া করে, মাথায় করে না কী ঠেলা গাড়ি করে? শুনে সবুজ হি হি করে হাসল, বলল, হেরোইন সোনা থেকে দামি, একটা ছোট প্রাস্টিকের ব্যাগে পাঁচ-দশ লাখ টাকার হেরোইন থাকে। স্কুলের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে যায়, ছোট মানুষ বলে কেউ সন্দেহ করে না। ঠিক ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিলেই নগদ টাকা। জালাল জানতে চাইল হেরোইন দেখতে কী রকম, সবুজ জানাল দেখতে সাদা রঙের দেখে মনে হয় গুড়া সাবান। জালাল জানতে চাইল হেরোইন কেমন করে খায়। সবুজ তখন কেমন করে মানুষ হেরোইন নেয় সেটা অভিনয় করে দেখাল। জালাল তখন জানতে চাইল মানুষ কেন হেরোইন খায়, সবুজ তখন বলল নেশা করার জন্যে। জালাল তখন জানতে চাইল সবুজ কখনো হেরোইন খেয়েছে কি না। সবুজ তখন হঠাৎ রেগে উঠে বলল সে কেন হেরোইন খাবে? সে কি হেরোইনখোর? জালাল তখন আর কোনো প্রশ্ন করল না।
সবুজ তখন তার সিগারেটের প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে সেটা ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিল আর জালাল তখন একটু অবাক হয়ে দেখল সবুজ আগের মতো কেশে উঠল না। সবুজ কালভার্টের উপর থেকে নিচের খালে থুতু ফেলে বলল, “তোরে আসলে এখনো আসল কথাটা কই নাই।”
“কী কথা?”
“কাউরে কইবি না তো?”
জালাল মাথা নাড়ল, “কমু না।”
সবুজ তখন জালালকে দিয়ে নানা রকম কিরা-কসম কাটিয়ে নিল, তারপর বলল, “আমি যখন হেরোইন আনা-নেওয়া করি তখন হেরোইনের প্যাকেট থেকে এক চিমটি হেরোইন সরায়া রাখি–কেউ টের পায় না। এই রকমভাবে আস্তে আস্তে যখন একটু বেশি হইব তখন আমি নিজে হেরোইনের ব্যবসা শুরু করুম।”