ইভা নরম গলায় বলল, “আমার দিকে তাকাও।”
জালাল ইভার দিকে তাকাল। ইভা বলল, “সত্যি করে বল দেখি কী হয়েছে?”
জালাল ইভার চোখের দিকে তাকাল। সেই চোখে কোনো রাগ নেই, অভিযোগ নেই। হঠাৎ করে জালাল বুঝতে পারে এই আপাকে সত্যি কথাটি বলা যায়। সে অপরাধীর মতো বলল, “আসলে আমি আপনার টাকা নিয়া ভাইগা গেছিলাম।”
“তারপর?”
“তারপর মনে হইল কামটা ঠিক হয় নাই। অন্যের লগে করা ঠিক আছে–আপনার লগে করা ঠিক হয় নাই।”
ইভা জালালের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “নাম কী তোমার?”
“জালাল।”
“ভেরি গুড জালাল। যাও।”
“আফনে উঠেন আফা, আমি আফনার ব্যাগটা তুইলা দেই। টেরেন ছাইড়া দিব।”
ইভা ওঠার পর জালাল ইভার হাতে ব্যাগটা তুলে দিল।
.
ট্রেন ছেড়ে দেবার পর যখন সেটা মোটামুটি স্পিড় নিয়েছে, শহরের ঘিঞ্জি অংশটুকু পার হয়ে গ্রাম, ধানক্ষেত, গরু, রাখাল, নদী নৌকা এসব দেখা যাচ্ছে তখন ইভা শুনতে পেল কেউ একজন তাকে ডাকছে। মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল কানাডার প্রফেসর।
ইভা কিছু বলার আগেই এনথ্রোপলজির প্রফেসর বলল, “আমি দেখেছি। দূর থেকে পুরো ব্যাপারটা দেখেছি।”
ইভা কিছু বলল না। মানুষটি বলল, “আমি হেরে গেলাম, কিন্তু আপনি একটা জিনিস জানেন?”
“কী?”
“আমি যদি টাকাটা দিতাম তা হলে মনে হয় ছেলেটা কোনোদিন ফিরে আসত না। সে ফিরে এসেছে কারণ টাকাটা দিয়েছেন আপনি।”
ইভা এবারেও কোনো কথা বলল না।
কানাডার প্রফেসর বলল, “আমি মানুষটা একটু গাধা টাইপের। সেই জন্যে আপনার সাথে কম্পিটিশন করতে গিয়েছিলাম। আমার উচিত শিক্ষা হয়েছে।”
ইভা বলল, “আসলে–” বলে থেমে গেল।
মানুষটা বলল, “আসলে কী?”
“মানুষের ভালো-মন্দ নিয়ে মনে হয় কম্পিটিশন করতে হয় না। মানুষকে মনে হয় বিচার করতে হয় না। যখন যে যেভাবে আসে তাকে মনে হয় সেভাবে নিতে হয়। আমি তাই নেই।”
কানাডার প্রফেসরকে কেমন জানি বিমর্ষ দেখায়, সে অন্যমনস্কর মতো মাথা নাড়ল। তার এততদিনের হাইপোথিসিসে গোলমাল হয়ে গেছে–মানুষটার মনে হয় একটা সমস্যা হয়ে গেল। ইভার মনে হল : আহা বেচারা!
.
০৩.
সবুজকে দেখে জালাল অবাক হয়ে বলল, “ভাই, তুমি?”
সবুজ তার ময়লা দাঁত বের করে হেসে বলল, “হ। আমি।”
জালাল অবাক হয়ে সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাকে দেখে চেনাই যায় না। একটা জিন্সের প্যান্ট, বুকের মাঝে ইংরেজি কথাবার্তা লেখা একটা টি-শার্ট পায়ে টেনিস সু। পকেটে সিগারেটের প্যাকেট। জালাল বলল, “ভাই তুমারে দেইখা তো চিনাই যায় না!”
সবুজ কথার উত্তর না দিয়ে পকেট থেকে একটা লাল রুমাল বের করে ঘাড় মুছল তারপর মুখে একটা তাচ্ছিল্য টাইপের হাসি ফুটিয়ে বলল, “না চিনার কী আছে? আমার কী মাথার মাঝে শিং গজাইছে যে চিনবি না?”
সবুজ এই কয়দিন আগেও স্টেশনে তাদের একজন ছিল। ট্রেন এলে দৌড়ে ট্রেনে উঠত, ব্যাগ নেবার জন্যে কাড়াকাড়ি করত, আবর্জনা জঞ্জাল ঘেঁটে নানা ধরনের জিনিসপত্র বের করত-দরকার হলে একটু চুরি-চামারি একটু ভিক্ষা করত। রাত্রিবেলা সবার সাথে প্রাটফর্মে ঘুমাত। মাঝখানে হঠাৎ সে উধাও হয়ে গেল। কোথায় গেছে কেউ জানে না–এটা অবশ্যি নতুন কিছু না স্টেশনে যারা থাকে তাদের যাবার কোনো জায়গা নেই তাই সব জায়গাই তাদের জায়গা। কেউ স্টেশনে কিছুদিন থেকে হয়তো বাজারে থাকা শুরু করল, বাজার থেকে হয়তো মাজারে, মাজার থেকে হয়তো স্টেডিয়ামে! একবার পথে-ঘাটে থাকা অভ্যাস হয়ে গেলে তখন কোথাও আর থাকার সমস্যা হয় না। তাই স্টেশনে যারা থাকে তারা যে সবসময়ই স্টেশনে থাকে তা নয়-তারা যায় আসে। সেই জন্যে সবুজ যখন হঠাৎ উধাও হয়ে গেল অন্যেরা এমন কিছু অবাক হয়নি। সবুজের বয়স তেরো চৌদ্দ এর কাছাকাছি, জালালের কাছাকাছি বয়সের ছেলেমেয়ে থেকে একটু বেশি তাই তাদের সাথে যোগাযোগটা ছিল একটু কম। সবুজের ওঠা বসা ছিল একটু বড়দের সাথে যারা একটু মাস্তান টাইপের, যারা মুখ খারাপ করে গালাগাল করতে পারে, যারা ধুমসে বিড়ি-সিগারেট খায় তাদের সাথে। তারপরেও এক স্টেশনে এক পাটফর্মে যারা ঘুমায় তাদের মাঝে একটা সম্পর্ক থাকে।
জালাল বলল, “ভাই, কই থাক এখন?”
সবুজ সরাসরি উত্তর না দিয়ে ঘাড় নাড়াল, চোখ নাচাল যেটার মানে যা কিছু হতে পারে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সেখান থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগিয়ে খুব কায়দা করে সেটাকে ধরাল। তারপর একটা টান দিয়ে খক খক করে কাশতে লাগল-বোঝাই যাচ্ছে সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটা সে এখনো শিখতে পারে নাই তাই কায়দা-কানুনটাই হচ্ছে এখন আসল ব্যাপার।
সবুজ ধোয়া ছেড়ে বলল, “তরার খবর কী?”
“ভালা।”
“রোজগারপাতি কী রকম?”
“বেশি ভালা না। কুনো পাবলিক টেহা-পয়সা দিবার চায় না।”
সবুজ বড় মানুষের মতো হা হা করে হাসল, হাসিটা অবশ্যি শুনতে ঠিক আসল হাসির মতো শুনাল না। মনে হল হাসিটাতে ভেজাল আছে। জালাল জিজ্ঞেস করল, “হাস ক্যান?”
“হাসুম না? তুই ছাগলের মতো কথা কইবি আর আমি হাসুম না? পাবলিক কি তোর সমুন্দী লাগে যে তরে টেহা-পয়সা দিব?”
“তয় তুমি এতো টেহা-পয়সা কই পাও?” সবুজ রহস্যের মতো ভঙ্গি করে বলল, “পাবলিক কুনো দিন টেহা-পয়সা দেয়। পাবলিক হইল কিরপনের যম। কিন্তুক বাতাসের মাঝে টেহা উড়ে, তুই যদি জানস তা হইলে তুই সেই টেহা ধরবি আর পকেটে ঢুকাবি!”