“অফকোর্স। হি শুড।”
“আর যদি না যায়?”
“তা হলে আমি বলব আমার হাইপোথিসিস ভুল। আমি পরাজয় স্বীকার করে নেব।”
“কার কাছে পরাজয় স্বীকার করবেন?”
“আপনার কাছে।”
ইভা বিরক্ত হয়ে বলল, “আমি তো কোনো গেম খেলছি না যে এখানে জয় পরাজয় আছে!”
“শুধু কী গেমে জয়-পরাজয় থাকে? আইডিয়াতেও থাকে।”
“থাকলে থাকুক আমার সেখানে কোনো মাথা ব্যথা নেই।” ইভা একবারে পাকাঁপাকিভাবে কথাবার্তা শেষ করার জন্যে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন জালাল এসে হাজির হল। সে এই মাত্র খবর পেয়েছে গত সপ্তাহের দুই টেকি আপা আজকেও এসেছে। আজকেও সবাইকে চাইতেই দুই টাকা করে দিচ্ছে। জালাল ইভার দিকে তাকিয়ে মুখ কাচুমাচু করে বলল, “আফা, সবাইরে দিছেন, আমারে দুই টেহা দিবেন না?”
এনথ্রোপলজির প্রফেসর মনে হল এই সুযোগটার জন্যে অপেক্ষা করছিল, গলা বাড়িয়ে বলল, “তুই আমার কাছে আয়, আমি দিচ্ছি। আপাকে ছেড়ে দে।”
জালাল কী করবে বুঝতে না পেরে একবার ইভার মুখের দিকে আরেকবার চুল নেই লম্বা মানুষটার দিকে তাকাল। মানুষটা পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে বলল, “আমার কাছে ভাংতি নাই, তুই টাকাটা ভাঙিয়ে আন–”
ইভা তখন তার ব্যাগ খুলে বলল, “দাঁড়াও।”
সাথে সাথে জালাল ইভার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ইভা বলল, “আমার ভাংতি শেষ হয়ে গেছে। তুমি এই একশ টাকার নোটটা ভাঙিয়ে নিয়ে এস। পারবে না?”
জালালের চোখ দুটি চকচক করে উঠল। বলল, “পারমু আফা।”
ইভা নোটটা বাড়িয়ে দেয়, জালাল কাঁপা হাতে নোটটা হাতে নিল। আজকে সকালে সে কার মুখ দেখে উঠেছিল? এরকম কপাল একজনের জীবনে আর কয়দিন আসে?
জালাল নোটটা নিয়ে ভিড়ের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাবার পর এনথ্রোপলজির প্রফেসর হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, বলল, “আপনি এটা কী করলেন? দশ টাকা দিলে তবুও হয়তো একটা কথা ছিল, হয়তো একটা চান্স ছিল! একশ টাকার লোভ এই বাচ্চা ছেলে কেমন করে সামলাবে? আমিই সামলাতে পারব না।” কথা শেষ করে মানুষটা হা হা করে হাসল।
ইভা কোনো কথা বলল না।
মানুষটা বলল, “আমি ভেবেছিলাম আপনার সাথে একটা ফেয়ার কম্পিটিশন করি আপনি আমাকে ওয়াক ওভার দিয়ে দিলেন।”
ইভা এবারেও কোনো কথা বলল না।”
“আমি সরি, শুধু শুধু আমার কথায় একশটা টাকা নষ্ট করলেন।”
ইভা এবারেও কোনো কথা বলল না।
”আমি যাই। আপনাকে আর বিরক্ত করব না।”
ইভা ভাবল। মনে মনে বলল, “আগেই যাবেন না, দেখে যান।” কিন্তু কিছু বলল না, সম্মতির ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। মানুষটি তখন ভিড়ের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ইভা ভেবেছিল পাঁচ মিনিটের মাঝে ছেলেটা ভাংতি টাকা নিয়ে আসবে। ছেলেটি এলো না। দশ মিনিট পরেও এলো না। পনেরো মিনিট পর স্টেশনে ঘোষণা দিল ট্রেন আধা ঘণ্টা লেট তখনো ছেলেটা এলো না। বিশ মিনিট পরেও যখন এলো না তখন ইভা বুঝতে পারল এনথ্রোপলজির প্রফেসরের কথা সত্যি, ছেলেটা আর আসবে না। হয়তো একশ টাকার একটা নোট না দিয়ে দশ টাকার একটা নোট দেওয়া উচিত ছিল তা হলে হয়তো আসত, হয়তো ইভা নিজেই বাচ্চাটাকে লোভের মাঝে ঠেলে দিল। ইভার মনটা একটু খারাপ হল। সারা জীবনই সে মানুষকে বিশ্বাস করে এসেছে। মানুষ সেই জন্যে অনেকবার তাকে কষ্ট দিয়েছে কিন্তু তারপরেও সে মানুষকে বিশ্বাস করে এসেছে। সে কখনোই মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস হারাবে না। শুধু মনের ভেতর খচখচ করছে–এইটুকুন একটা ছেলে তার বিশ্বাসটাকে সম্মান করল না? নিজেকে কেমন জানি অপমানিত মনে হচ্ছে। ভাগ্যিস হামবাগ কানাডার প্রফেসর আশেপাশে নেই, তা হলে মনে হয় অপমানটা আরো বেশি গায়ে লাগত।
ত্রিশ মিনিট পর স্টেশনে ঘোষণা দিল ট্রেনটা আজকে এক নম্বর পাটফর্মের বদলে দুই নম্বর পাটফর্মে আসবে। প্যাসেঞ্জাররা সবাই যেন দুই নম্বর প্লাটফর্মে চলে যায়। ইভা তখন শেষবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে ওভার ব্রিজের উপর দিয়ে দুই নম্বর প্লাটফর্মের দিকে যেতে থাকে। ছেলেটা যদি এখন একশ টাকার ভাংতি নিয়ে চলেও আসে আর তাকে খুঁজে পাবে না।
দুই নম্বর প্লাটফর্মে ইভার সাথে আবার এনথ্রোপলজির প্রফেসরের দেখা হয়ে গেল। প্রফেসর কাছে এসে নিচু গলায় বলল, “ড্র।”
ইভা ঠিক বুঝতে পারল না, বলল, “কী বললেন?”
“বলেছি ড্র হয়ে গেল।”
“কীসের ড্র?”
“আমাদের কম্পিটিশানের। আপনি এখন বলতে পারবেন ছেলেটা হয়তো ঠিকই ভাংতি নিয়ে এসেছিল কিন্তু আপনাকে আর খুঁজে পায় নাই। টেকনিক্যাল কারণে ড্র হয়ে গেল।”
ইভা কিছু বলল না, সে টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে ড্র করতে চায়নি। সে একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে জিততে চেয়েছিল। পারল না।
.
ঠিক যখন ট্রেনটা এসেছে, ইভা যখন ট্রেনে উঠতে যাবে তখন সে পিছনে উত্তেজিত একটা গলা শুনতে পেল, “আফা! আফা! দুই টেকি আফা!”
ইভা মাথা ঘুরিয়ে জালালকে দেখতে পায়। তার হাতে মুঠি করে ধরে রাখা অনেকগুলো নানা ধরনের নোট। জালাল ইভার দিকে হাতটা বাড়িয়ে বলল, “আফা, আপনের ভাংতি টাকা।”
ইভা টাকাগুলো নিল, অনেকগুলো ময়লা নোট, তার ভেতর থেকে দুই টাকার একটা নোট বের করে জালালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও।”
জালাল নোটটা হাতে নিয়ে বলল, “আসলে আফা আপনারে খুইজা পাইছিলাম না। প্লাটফর্ম বদলি হইছে তো।”
ইভা জালালের চোখের দিকে তাকাতেই চোখটা নামিয়ে নিয়ে নিচু গলায় বলল, “আমারে কেউ একশ টাকার ভাংতি দিতেও চায় না, হেই জন্যে–”