- বইয়ের নামঃ ইস্টিশন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ তাম্রলিপি
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-৩. টেরেন আহে
ইস্টিশন – কিশোর উপন্যাস – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
মায়া চিৎকার করে বলল, “টেরেন আহে। টেরেন!”
মায়ার সামনের দাঁতগুলো পড়ে গিয়েছে তাই কথা বলার সময় তার দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাতাস বের হয়ে শব্দগুলোকে অন্যরকম শোনা যায়। সে আসলে বলার চেষ্টা করেছে”ট্রেন আসছে-ট্রেন!” মায়া শুধু যে ট্রেনকে টেরেন বলে তা নয়–সে গ্রামকে বলে গেরাম, ড্রামকে বলে ডেরাম! তাকে কেউ অবশ্যি সেটা শুদ্ধ করে দেবার চেষ্টা করে না, কারণ রেলস্টেশনে সে অন্য যে কয়জন বাচ্চা-কাচ্চার সাথে থাকে তারাও ট্রেন আর টেরেন কিংবা ড্রাম আর ডেরামের মাঝে পার্থক্যটা ভালো করে ধরতেও পারে না, বলতেও পারে না।
মায়ার চিৎকার শুনে জালাল আর তার সাথে সাথে অন্যেরাও মাথা ঘুরিয়ে রেল লাইনের দিকে তাকাল, দূরে ট্রেনটাকে দেখা যাচ্ছে–আন্তঃনগর জয়ন্তিকা। পাকা দেড়ঘণ্টা লেট।
জালালের হাতে একটা তরমুজের টুকরা, তার মাঝে যেটুকু খাওয়া সম্ভব সেটুকু সে অনেক আগেই খেয়ে ফেলেছে তারপরেও সে অন্যমনস্কভাবে টুকরাটাকে কামড়া-কামড়ি করছিল। তরমুজটা এনেছে মজিদ, ফুট মার্কেটের পাশে দিয়ে আসার সময় প্রত্যেক দিনই সে কলাটা না হয় আপেলটা চুরি করে আনে। স্টেশনে এসে সে প্লাটফর্মের রেলিংয়ে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে সবাইকে দেখিয়ে তৃপ্তি করে খায়। আজকে সে কীভাবে জানি আস্ত একটা তরমুজ নিয়ে এসেছে। কলাটা কিংবা আপেলটা চুরি করে আনা সম্ভব, তাই বলে আস্ত একটা তরমুজ? কীভাবে এতো বড় একটা তরমুজ চুরি করে এনেছে মজিদকে সেটা জিজ্ঞেস করে অবশ্যি কোনো লাভ হল না, সে কিছুই বলতে রাজি হল না। আস্ত একটা তরমুজ মজিদের একার পক্ষে খেয়ে শেষ করা সম্ভব না তাই সে আজকে অন্যদেরও ভাগ দিয়েছে। তরমুজটা ভাগাভাগি করার সময় অবশ্যি মায়া কিংবা মরি মতো ছোট বাচ্চাগুলো বেশি সুবিধে করতে পারেনি। জালাল, জেবা আর শ হজাহানের মতো একটু বড়রাই তরমুজটা কাড়াকাড়ি করে নিয়েছে।
ট্রেনটা আরো কাছে চলে এসেছে, রেল লাইনে হালকা একটা কাঁপুনি টের পাওয়া যাচ্ছে। জালাল তার হাতের তরমুজের টুকরাটা রেললাইনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎ সবাই একসাথে হইহই করে ট্রেনের দিকে ছুটতে শুরু করে। জালাল কিংবা মায়ার মতো যারা স্টেশনেই থাকে তাদের কাছে ট্রেনটাই হচ্ছে বেঁচে থাকার উপায়। এই ট্রেনের ওপরেই তাদের থাকা-খাওয়া সবকিছু নির্ভর করে। ট্রেনে যে যত আগে উঠতে পারবে কিছু একটা আয় রোজগার করার সম্ভাবনা তার তত বেড়ে যাবে, তাই সবাই ট্রেন থামার আগেই লাফিয়ে সেটাতে ওঠার চেষ্টা করে। সবার আগে জালাল বিপজ্জনকভাবে লাফ দিয়ে ট্রেনের একটা বগিতে উঠে গেল। প্রায় সাথে সাথে জেবা, মজিদ, শাহজাহানও লাফিয়ে একেকজন একেকটা বগিতে উঠে পড়ল। মায়া কিংবা মতির মতো যারা ছোট, যারা এখনো লাফিয়ে চলন্ত ট্রেনে ওঠা শিখেনি তারা ট্রেনটার পাশাপাশি ছুটতে থাকে–ট্রেনটা থামলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা ট্রেনে উঠবে।
ট্রেনের বগিতে উঠেই জালাল সতর্ক চোখে প্যাসেঞ্জারদের লক্ষ করে। ট্রেন দেড়ঘণ্টা লেট করে এসেছে তাই প্যাসেঞ্জারদের পেটে খিদে, সবাই কম-বেশি ক্লান্ত, সবারই মেজাজ কম-বেশি খারাপ। এর মাঝে জালালের মতো রাস্তার একটা বাচ্চাকে ট্রেনের মাঝে ছোটাছুটি করতে দেখে তাদের মেজাজ আরো গরম হয়ে উঠতে লাগল। জালালের মতোই অন্যেরাও ট্রেনের বগিতে ছোটাছুটি করে সিটের উপরে, সিটের নিচে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে যায়। খালি পানির বোতল, ফেলে যাওয়া চিপসের প্যাকেট, খবরের কাগজ, আধ খাওয়া আপেল কুড়াতে কুড়াতে তারা ছুটতে থাকে। তাদের ছোট ছোট নোংরা শরীরের ধাক্কা খেয়ে প্যাসেঞ্জাররা খুবই বিরক্ত হয়, দুই একজন মুখ খিঁচিয়ে তাদের গালাগালিও করে। বাচ্চাগুলো অবশ্যি সেই গালাগালকে কোনো পাত্তা দেয় না। তারা পথে-ঘাটে গালাগাল চড়-থাপড় খেয়ে বড় হয়েছে, মুখের গালাগাল তাদের জন্যে কোনো ব্যাপারই না। সত্যি কথা বলতে কী তারা এই গালাগাল ভালো করে শুনতেও পায় না।
জালাল প্যাসেঞ্জারদের চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝারি বয়সের একজনকে বের করল, মানুষটা ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন থেমে যাবার সাথে সাথে নেমে যাবার জন্যে ব্যস্ত। চেহারা দেখে মনে হয় মানুষটার মাঝে একটু দয়া-মায়া আছে। জালাল কাছে গিয়ে মাথাটা বাঁকা করে নিজের চেহারার মাঝে একটা দুঃখি দুঃখি ভাব ফুটিয়ে নিয়ে নিচু গলায় বলল, “স্যার! ব্যাগটা নিয়া দেই?”
মানুষটা মুখ শক্ত করে বলল, “লাগবে না। যা–ভাগ।”
জালাল তার চেহারায় আরো কাচুমাচু ভাব নিয়ে আসে, “স্যার, একটু ভাত খাইতাম। কিছু খাই নাই। পেটে ভুখ।”
কথাটা সত্যি না, আজকে দুপুরে সে ঠেসে খেয়েছে। স্টেশনের পাশে জালালীয়া হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট। সকালবেলা সেখানে যখন মুরগি জবাই করছে তখন একটা মুরগি কেমন করে জানি ছুটে গেল। কঁক কঁক করে ডাকতে ডাকতে সেটা নালার উপর দিয়ে দৌড়াতে লাগল। শুধু তাই না মুরগি হওয়ার পরও পাখির মতো ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়ে সেটা রেলওয়ে গেস্ট হাউজের দেয়ালের উপর উঠে গেল। জালাল সেই দুর্ধর্ষ মুরগিটাকে ধরে এনে দিয়েছে। হোটেল ম্যানেজার সেই জন্যে তাকে দুপুরবেলা এক পেট খেতে দিয়েছে। ভাত, বিফ ফ্রাই আর ডাল। হোটেলের রান্নাঘরের কাছে যেখানে মোটা মোটা মহিলারা বসে পেঁয়াজ কাটে সেখানে বসে সে অনেকদিন পর তৃপ্তি করে খেয়েছে–যতবার বলেছে”আরো ভাত” ততবার তাকে ভাত দিয়েছে, সাথে বিফ ফ্রাইয়ের ঝোল আর ডাল। তারপর স্টেশনে এসে মজিদের চুরি করে আনা তরমুজের বিশাল একটা টুকরা খেয়েছে। কাজেই পেটে আর যাই থাকুক খিদে নাই-কিন্তু এই কথাগুলো