ঠিক যখন রাত দশটার ঘণ্টা বাজলো তখন স্টোররুমের দরজার পিছন থেকে ছোট একটা নেংটি ইঁদুর খুব সাবধানে মাথা বের করল। নেংটি ইঁদুরের সময়ের জ্ঞান যে এতো ভাল আমি কখনো জানতাম না। গত কয়েক দিন থেকে লক্ষ্য করছি ঠিক দশটার সময় এই নেংটি ইঁদুরটা স্টোররুমের দরজার পিছন থেকে উঁকি দেয়। প্রথম কয়েক দিন আমাকে দেখেই লাফ দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, এখন আমাকে দেখে একটু অভ্যস্ত হয়েছে। নেংটি ইঁদুরের প্রিয় খাবার কী কে জানে–আমি রুটির কয়েকটা টুকরো ছড়িয়ে রেখেছিলাম, গত কয়েক দিন থেকে দেখছি টুকরোগুলো দুই হাতে ধরে কুট কুট করে খাচ্ছে। নেংটি ইঁদুরের খাওয়ার ভঙ্গিটা ভারি সুন্দর, দেখে আমার এতো মজা লাগে যে বলার মতো নয়। আমার হাতে ছোট এক টুকরো রুটি ছিল, সেটা এগিয়ে দিলাম, নেংটি ইঁদুরটা একটা ছোট লাফ দিয়ে সরে গেলো। দূর থেকে আমাকে সাবধানে লক্ষ্য করল, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে রুটির টুকরোটা মুখে করে একটু দূরে টেনে নিয়ে গেল। আমার দিকে সাবধানে তাকিয়ে সে দুই হাতে টুকরোটা ধরে কুটুর কুটুর করে খেতে শুরু করে। আমি ফিসফিস করে নেংটি ইঁদুরটাকে ডাকলাম, এই! এই পিচকি। এই মিচকি!
নেংটি ইঁদুরটা আমার ডাক শুনে খুব যে উৎসাহিত হলো সেরকম মনে হলো না, সাবধানে রুটির টুকরোটা নিয়ে আরেকটু দূরে সরে গেলো। আমি আরেকটু গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, মিচকি। এই মিচকি।
নেংটি ইঁদুরটা এবার একটু ভড়কে গিয়ে তার রুটির টুকরোটা ফেলে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেল। আমি অবশ্যি খুব হতাশ হলাম না, কারণ আমি জানি আগামীকাল রাত দশটার সময় সে আবার এসে হাজির হবে। আবার ইতিউতি তাকিয়ে আমার আরেকটু কাছে আসবে। এই বাসায় আমার একমাত্র বন্ধু এই নেংটি ইঁদুর, ব্যাপারটার মাঝে কোথায় জানি একটু দুঃখের চিহ্ন আছে।
পরের দিন ক্লাসে গিয়ে আমি মনে মনে আশা করছিলাম যে প্রিয়াংকা আজকেও আমার পাশে বসবে। কিন্তু দেখলাম সে আজকে অন্য পাশে বসেছে। আজকেও তার মুখে এক ধরনের হাসি, চারিদিকে দেখতে দেখতে পা দোলাচ্ছে, দেখে। মনে হয় পুরো ক্লাসটা যেন একটা নাটকের দৃশ্য, সে যেন একজন দর্শক এবং যেন খুব আগ্রহ নিয়ে নাটকটা দেখছে। আমি আমার সিটে বসলাম, অন্যদিন হলে ক্লাস রুমে থেকে বের হয়ে বাউন্ডারি ওয়ালে পা ঝুলিয়ে বসতাম। আজ আর বের হলাম না, প্রিয়াংকা যেরকম আগ্রহ নিয়ে পুরো ক্লাসকে দেখে আমিও অনেকটা সেভাবে দেখতে শুরু করলাম।
ব্যাপারটি মন্দ না, যেমন ধরা যাক ইশতিয়াকের ব্যাপারটা। সে যে এতো মনোযোগ দিয়ে কেনে আঙুল দিয়ে কান চুলকাতে পারে আমি সেটা জানতাম না। তাকে দেখে মনে হয় চুলকাতে চুলকাতে কানের মাঝে গর্ত করে ফেলবে। আদনান পকেট থেকে কী একটা বের করে মুখে দিয়ে খাচ্ছে, খুব সতর্কভাবে খাচ্ছে যেন কেউ বুঝতে না পারে। বুঝতে পারলে যদি ভাগ দিতে হয় সেজন্যে এরকম সাবধান। নাঈমা নামের ফর্সা মেয়েটা নিজের চেহারা নিয়ে নিশ্চয়ই খুব সচেতন, ব্যাগ থেকে ছোট একটা আয়না বের করে নিজেকে দেখে চুলগুলো একটু সামনে নিয়ে এসে আবার আয়নাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল। মুশফিক আর জহুরুল গল্প করছে, কি নিয়ে গল্প করছে শোনা যাচ্ছে না কিন্তু বিষয়টা নিশ্চয়ই খুব মজার। দুইজনে দাত বের করে হি হি করে হাসছে! মানুষকে হাসতে দেখা খুব মজার একটা বিষয়, তাদেরকে দেখে আমারও হাসি পেয়ে গেলো!
আমাদের ক্লাসের দুই ভাল ছাত্র জয়ন্ত আর মামুন নিশ্চয়ই কোন জ্ঞানের বিষয় নিয়ে কথা বলছে কারণ দুইজনের চোখে-মুখেই এক ধরনের গম্ভীর ভাব। তারা কথা বলতে বলতে আমার কাছাকাছি চলে এলো বলে জ্ঞানের বিষয়টা আমিও শুনতে পেলাম, জয়ন্ত বলছে, বল দেখি কোন সংখ্যাকে যতবার সেটা দিয়ে গুণ করা হোক প্রথম সংখ্যা সেটাই হয়?
এই সহজ বিষয়টা নিয়ে দুইজন এরকম গম্ভীর হয়ে কথা বলছে দেখে আমার হাসি পেয়ে গেল! এরকম সংখ্যা দুটি হচ্ছে পাঁচ আর ছয়। মামুন দেখলাম কয়েকবার মাথা চুলকে চিন্তাভাবনা করে বলল, পাঁচ।
জয়ন্ত বলল, আরো একটা আছে।
মামুন আবার মাথা চুলকাতে শুরু করল। একটু চিন্তা করে বলল, ছয়।
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। এবার বল দেখি দুই অংকের কোন সংখ্যাকে যতবার নিজের সাথে গুণ করা যায় ততবার প্রথমে সেই সংখ্যাটা পাওয়া যায়?
মামুনকে আবার একটু বিভ্রান্ত দেখায়। ভুরু কুঁচকে চিন্তা করতে শুরু করে। মামুন সবসময় পরীক্ষায় ফাস্ট-সেকেন্ড হয়, অথচ এরকম সহজ একটা জিনিস চিন্তা করে বের করতে তার এতোক্ষণ লাগে? যে কেউ বলতে পারবে, সংখ্যাটা হচ্ছে পঁচিশ!
মামুন বলল, দাড়া ক্যালকুলেটরটা নিয়ে আসি।
জয়ন্ত বলল, উঁহুঁ ক্যালকুলেটর দিয়ে করলে হবে না। এমনি এমনি বের করতে হবে।
মামুন বলল, এতগুলো গুণ করব? একশটার মতো।
আমার আবার হাসি পেলো, শুধু নামেই ফাস্ট-সেকেন্ড আসলে মাথায় কিছু নেই। বোঝাই যাচ্ছে সংখ্যার প্রথম অংকটা হবে পাঁচ না হয় ছয়। শুধু সেই সংখ্যাগুলো পরীক্ষা করতে হয়। যেমন পনেরো, পঁচিশ, পঁয়ত্রিশ কিংবা ষোল, ছাব্বিশ, ছত্রিশ। কতোক্ষণ আর লাগবে?
মামুন এবারে একটা কাগজ নিয়ে গুণ করতে শুরু করল, কী আশ্চর্য! এই সংখ্যাগুলো গুণ করতে কাগজ-কলম লাগে? মাথার ভিতরেই তো করে ফেলা যায়। পঁচিশ পঁচিশে ছয়শ পঁচিশ, পঁয়ত্রিশ পয়ত্রিশে বারোশ পঁচিশ, পঁয়তাল্লিশ পঁয়তাল্লিশে দুই হাজার পঁচিশ।