আমার কথা শুনে রাজাকার স্যার একেবারে থতমত খেয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন, তারপর কয়েকবার চেষ্টা করে
বললেন, কী বললি?
আমি বললাম, বলেছি যে কাউকে মারবেন না।
আমার গলার স্বরটা এবারে আগের থেকেও ভয়ানক শোনালো। কথা বলে অভ্যাস নেই বলে যেটাই বলি সেটাই ভয়ানক শোনায়, এবারের কথাটা শোনালো এরকম : একটা কথা কয়বার বলতে হয়? শেষবারের মতো বলছি। শুনে রাখেন, খবরদার আমাদের ক্লাসের কোন ছেলের গায়ে হাত তুলবেন না। যদি তুলেন তাহলে খবর আছে। খুন করে রাস্তায় লাশ ফেলে দেব! আমাকে চেনেন না? জন্মের মতো সিধে করে দেব।
আমার কথায় ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। রাজাকার স্যার কেমন যেন মাছের মতো খাবি খেতে লাগলেন। সারা ক্লাশে একটা গুঞ্জন শুরু হলো–ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের যখন খুশি মারপিট করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের গুঞ্জন। রাজাকার স্যার দুর্বল গলায় বললেন, চুপ।
কিন্তু কেউ চুপ করল না বরং গুঞ্জনটা আরো বেড়ে গেল। আমি চারিদিকে তাকিয়ে বললাম, চুপ। সাথে সাথে পুরো ক্লাস চুপ করে গেলো।
রাজাকার স্যার বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, মারলে কী করবি?
আমি বললাম, মেরে দেখেন কী করি।
আমার কথা শুনে সারা ক্লাসে একটা আতংকের শিহরণ বয়ে গেল, আমি স্পষ্ট দেখলাম ভয়ে ছেলে-মেয়েদের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। ছেলে-মেয়েদের থেকে বেশি ভয় পেলেন রাজাকার স্যার, মাছের মতো খাবি খেতে লাগলেন। স্যার কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না, আমি তাই মেঘের মতো গলার স্বরে বললাম, দিলীপ, তুই তোর জায়গায় গিয়ে বস। প্রিয়াংকা তুমিও চলে আস।
আমার কথা শুনে দিলীপ সুড়ুৎ করে নিজের জায়গায় এসে বসে পড়ল। প্রিয়াংকাও কী করবে বুঝতে না পেরে নিজের জায়গায় ফিরে এলো। রাজাকার স্যার আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, আমিও সোজা তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখ থেকে আগুন বের হওয়া বলে একটা কথা আছে, আমি সেটাই চেষ্টা করলাম। গত কয়েক বছর আমি মোটামুটি একটা পশুর মতো সময় কাটিয়েছি। আমার আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা সবকিছু পশুর মতো হয়ে গিয়েছে, চোখের দৃষ্টিটাও মনে হয় সেইরকম হিংস্র হয়ে গেছে, রাজাকার স্যার সেই চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলেন না, চোখ সরিয়ে নিলেন।
স্যার কিছুক্ষণ ক্লাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইলেন তারপর বইটা হাতে নিয়ে কাঁপা গলায় বললেন, একত্রিশ পৃষ্ঠায় দুই নম্বর প্রশ্নের উত্তর লেখ। কথা বলবি না।
কেউ কোন কথা বলল না, খাতা খুলে প্রশ্নের উত্তর লিখতে শুরু করল।
প্রিয়াংকা তার খাতা খুলতে খুলতে নিচু গলায় বলল, তপু।
আমি প্রিয়াংকার দিকে তাকালাম, বললাম, কী হলো?
থ্যাংক ইউ তপু। তারপর সে হাত বাড়িয়ে আমার হাতটা একবার স্পর্শ করল।
আমি কিছু না বলে সামনের দিকে তাকালাম। আহা! কতোদিন পরে একজন আমার সাথে ভাল করে, সুন্দর করে কথা বলল। কেউ যখন এরকম ভালাবাসা নিয়ে কথা বলে তখন কী ভালই না লাগে। হঠাৎ করে আমার চোখে পানি এসে গেল।
আমি ভেবেছিলাম আমার চোখের সব পানি শুকিয়ে গেছে, আসলে শুকায় নি। বুকের ভিতরে গভীরে কোন একটা জায়গায় এখনো মনে হয় অনেক চোখের পানি জমে আছে।
০৩. প্রিন্সিপাল ম্যাডাম
আমি বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়াটা কয়েক দিনের জন্যে পিছিয়ে দিলাম। কেন। ঠিক পিছিয়ে দিলাম নিজেই জানি না, নিজেকে নিজে বোঝালাম যে বাসা থেকে সত্যি সত্যি পালিয়ে যাবার আগে আমার অন্তত একবার আম্মু, আপু আর ভাইয়ার সাথে শেষবার দেখা করে যাওয়া দরকার। সেটা অবশ্যি সত্যি কারণ হতে পারে না, আমাকে দেখলেই আম্মু যেভাবে খেপে যান যে দেখা না হওয়াই ভাল। আপু আর ভাইয়ার সাথে দেখা হলে তারা এতো অপ্রস্তুত হয়ে যায় যে কোথায় গিয়ে লুকাবে বুঝতে পারে না। তাই তাদের সাথে দেখা করে যাওয়াটাও আসল কারণ হতে পারে না। আমার ধারণা আসল কারণটা হচ্ছে প্রিয়াংকা, এই মেয়েটা একটু খ্যাপা টাইপের। মনে হচ্ছে ক্লাসে আরো কিছু অঘটন ঘটাবে, ঠিক কী অঘটন কীভাবে ঘটাবে সেটা দেখার একটা কৌতূহল হচ্ছে। তার ওপর রাজাকার স্যারকে যেভাবে হুমকি দিয়ে এসেছি সেটা নিয়ে স্কুলে একটু হৈচৈ হতে পারে, ব্যাপারটা কোন দিকে গড়ায় সেটা না দেখে পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
ডাইনিং টেবিলে বসে যখন আম্মু আপু আর ভাইয়া খেতে খেতে গল্প করে আমি তখন স্টোররুমে আমার বিছানাটায় গুটিশুটি মেরে বসে থাকি। তাদের কথাবার্তা পুরোটুকু শোনা যায় না, একটা দুটি কথা হঠাৎ মনে হয় ছিটকে ছিটকে আসে। আমি মাঝে মাঝে কান পেতে শোনার চেষ্টা করি তারা কী নিয়ে কথা বলে। আজকে মনে হচ্ছে তারা টেলিভিশনের কোন একটা নাটক নিয়ে কথা বলছে–আমার কাছে এসব কত দূরের একটা বিষয়। নাটকের কোন একটা চরিত্রের কথা বলে তিনজন হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল। তাদের হাসির শব্দ শুনে মনে হলো সেটা বুঝি অন্য কোন জগৎ থেকে ভেসে আসছে! শুনতে শুনতে আমার বুক ভেঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। আমি দুই হাতে নিজের কান চেপে ধরে বসে থাকি, সবকিছু ভুলে মাথাটা ফাকা করে দেবার চেষ্টা করতে থাকি। আগে হলে কোন একটা বই খুলে কিছু একটা পড়ার চেষ্টা করতাম, বাসা থেকে পালিয়ে যাব ঠিক করার পর সেটাও ছেড়ে দিয়েছি। বনে জঙ্গলে, নদীর তীরে হাঁটতে হাঁটতেই যখন জীবনটা কাটিয়ে দেব তখন শুধু শুধু পড়াশোনা করে সময় নষ্ট করে কী হবে?