আজকেও তাই হলো, সাথে সাথে রাজাকার স্যার এসে খপ করে দিলীপের চুলের মুঠি ধরে তাকে হিড়হিড় করে টেনে এনে পেটাতে শুরু করলেন। স্যারের মনে কোন দয়ামায়া নেই, একেবারে পশুর মতো পেটাতে পারেন আজকে মনে হয় রাগটা আরেকটু বেশি, ধরেই যেভাবে মারতে শুরু করলেন তার কোন তুলনা নেই।
ঠিক তখন একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটল, যার জন্যে রাজাকার স্যার দূরে থাকুক আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। আমার পাশে বসে থাকা মেয়েটা তড়াক করে লাফ দিয়ে ওঠে, না স্যার, না স্যার বলে চিৎকার করতে করতে ক্লাসের সামনে ছুটে গেল। স্যার কিছু বোঝার আগেই সে দিলীপকে ধরে স্যারের হাত থেকে ছুটিয়ে নেয়। দিলীপের সামনে দাঁড়িয়ে সে মাথা নেড়ে বলে, না স্যার, প্লিজ। আপনি মারবেন না।
স্যারের কয়েক সেকেন্ড লাগল বুঝতে কী হচ্ছে, যখন বুঝতে পারলেন তখন একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলেন। দেখতে দেখতে স্যারের মুখ রাগে বিকৃত হয়ে গেলো, কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর চিৎকার করে বললেন, সরে যাও আমার সামনে থেকে বেয়াদব মেয়ে।
এতো বড় ধমক খেয়েও মেয়েটার এতটুকু ভাবান্তর হলো না, বরং মনে হলো তার মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল। মুখটা হাসি হাসি রেখেই অনুনয়ের গলায় বলল, না স্যার। প্লিজ। আমি স্যার এই ক্লাসে নতুন এসেছি–ক্লাসের সবাই আমার বন্ধু। একজন বন্ধুর সামনে আরেকজন বন্ধুকে মারলে তার খুব লজ্জা হয় স্যার। প্লিজ স্যার–লজ্জা দেবেন না স্যার।
লজ্জা? লজ্জা হয়? স্যার দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, আমার সাথে তুই মশকরা করিস? এইখানে কারো ভিতরে কোন লজ্জা-শরম আছে? যতো সব বেহায়া-বেয়াদব বেজন্মার দল-
রাজাকার স্যারের এতো বড় হুংকারের মাঝেও মেয়েটা ঘাবড়ালো না। ঠাণ্ডা গলায় বলল, না স্যার, লজ্জা আছে। আমাদের সবার ভেতরে লজ্জা আছে। আমাদের মারলে ব্যথাটা সহ্য করতে পারি, কিন্তু স্যার লজ্জাটা সহ্য করতে পারি না।
আমি এইবারে নড়েচড়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম। সত্যিই তো, আমার আম্মু যখন আমাকে নির্দয়ভাবে মারেন একটু পরেই আর ব্যথার অনুভূতিটা থাকে না। তখন শুধু থাকে লজ্জা আর অপমান। এই মেয়েটা তো সত্যি কথাই বলছে। আমরা ছোট হতে পারি তাই বলে আমাদের মান-অপমান নেই, লজ্জা নেই–সেটা তো সত্যি নয়। এই প্রথমবার পাগলাটে ধরনের নতুন মেয়েটাকে আমি একটু গুরুত্ব দিয়ে লক্ষ্য করলাম। হালকা-পাতলা শ্যামলা একটা মেয়ে। ছোট ছোট করে চুল কেটেছে, অনেকটা প্রায় ছেলেদের মতো, চোখে-মুখে এক ধরনের তীব্র অনুভূতির ছাপ, দেখে মনে হচ্ছে দিলীপকে রাজাকার স্যারের হাত থেকে রক্ষা করাটাই বুঝি তার জীবনের সবকিছু। যাকে রক্ষা করার জন্যে মেয়েটা এতো বড় একটা বিপদের ঝুঁকি নিয়েছে সেই দিলীপকে কিন্তু মোটেও বিচলিত দেখা গেলো না। সে মোটামুটি উদাস উদাস মুখে পুরো ব্যাপারটা নির্লিপ্তভাবে দেখছে, দেখে মনে হচ্ছে এখানে কী হচ্ছে তাতে তার কিছু আসে যায় না।
রাজাকার স্যার কেমন যেন বিস্ফারিত চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কেউ যদি স্যারকে না চিনে তাহলে তার কাছে স্যারের চেহারাটা মনে হয় ভালই মনে হবে কিন্তু আমরা তাকে একেবারে দুই চোখে দেখতে পারি না। বলে কখনোই তার চেহারাটাকে ভাল মনে হয় নি। এখন রেগে যাবার পর তার চেহারাটাকে আরো খারাপ মনে হতে থাকে তাকে ঠিক মানুষ নয় একটা খ্যাপা কুকুরের মতো দেখাতে থাকে। স্যারের সব রাগ মনে হয় এইবার মেয়েটার ওপরে এসে পড়ল। তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল, নাকের গর্তগুলো বড় হয়ে গেল, মুখ থেকে দাঁতগুলো বের হয়ে এলো আর তাকে দেখাতে লাগলো ভয়ংকর। স্যারের এই চেহারাটা দেখেও মেয়েটা ভয় পেলো না, বেশ ঠাণ্ডা। মাথায় বলল, প্লিজ স্যার আপনি মারবেন না। একজনকে মারলে কোন লাভ হয় না স্যার।
আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, স্যার রাগে অন্ধ হয়ে গেছেন, দিলীপকে নয় এখন এই খ্যাপা মেয়েটাকে মেরে বসবেন। আমি দেখতে পাচ্ছি তার হাত উপরে উঠে আসছে, আমি জানি এখন খপ করে মেয়েটার চুল ধরে একটা হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন, তারপর মুখের মাঝে মারবেন। মেয়েটা কিছু লক্ষ্য করল বলে মনে হলো না, সে আগের মতোই ঠাণ্ডা গলায় বলতে লাগল, স্যার আপনি আমার কথা বিশ্বাস না করলে অন্যদের জিজ্ঞেস করেন। জিজ্ঞেস করেন স্যার।
রাজাকার স্যার জিজ্ঞেস করার কোন উৎসাহ দেখালেন না, মেয়েটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলেন তখন আমি দাড়িয়ে চিৎকার করে বললাম, স্যার।
স্যার মাথা ঘুরে তাকালেন। চোখ লাল করে বললেন, কী?
আমি ঠিক করেছি পালিয়ে যাব, এই স্কুলে আর আমাকে আসতে হবে না! আমি ইচ্ছে করলে যা খুশি করতে পারি, কেউ আমাকে কিছু বলতে পারবে না, কেউ কিছু করতেও পারবে না। এটাই আমার সবচেয়ে বড় সুযোগ। এই সুযোগটা হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না। আমি হাত ছাড়া করলাম না; মুখ গম্ভীর করে বললাম, কাউকে মারবেন না।
প্রিয়াংকা নামের এই মেয়েটি কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে, রাজাকার স্যারের ভয়ংকর চোখ রাঙানির সামনেই সে ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলে যাচ্ছে। আমার অবস্থা ঠিক তার উল্টো। আমি গত কয়েক বৎসর বলতে গেলে কারো সাথে কথা বলি নাই, কীভাবে কথা বলতে হয় আমি সেটা ভুলেই গেছি। তাই আমি যখন বললাম, কাউকে মারবেন না। সেটা শুনালো এরকম : খবরদার! কাউকে মারবেন না। মারলে একেবারে খুন করে ফেলব।