মানুষ যে সুন্দর করে বা ভাল করে কথা বলতে পারে আমি সেটা ভুলেই গেছি। আমার সাথে কেউ ভাল ব্যবহার করে না, আমিও করলাম না। বললাম, মেয়ে বলে বেঁচে গেলে। ছেলে হলে এমন উঁচা দিতাম যে তখন খালি মনে শরীরের গিটটুতে গিটটুতেও কষ্ট পেতে!
মেয়েটা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল আমি তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে এলাম। বের হওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম ক্লাসের বেশ কয়েকটা ছেলেমেয়ে মেয়েটার কাছে ছুটে গেলো, নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে খোঁজখবর দিয়ে সাবধান করে দেবে। ক্লাসে ফিরে আসার পর মেয়েটা যে আমার থেকে দূরে নিরাপদ একটা জায়গায় বসবে সে বিষয়েও আমার কোন সন্দেহ নেই। ক্লাস শুরু হতে এখনো দেরি আছে। আমি ততক্ষণ স্কুলের বাউন্ডারি ওয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে চারপাশের সবকিছু দেখে সময় কাটাই। আমার কোন বন্ধু নাই, কোন আপনজন নাই–আমি সব সময় একা একা থাকি।
ঘণ্টা পড়ার পর ক্লাসে ফিরে এসে দেখলাম মেয়েটা আমার জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে একটু সরে বসেছে। কিন্তু পুরোপুরি সরে গিয়ে নিরাপদ জায়গায় বসে নি। আমাকে দেখে খুব মনোযোগ দিয়ে আমাকে লক্ষ্য করল কিন্তু কিছু বলল না। আমি সরাসরি তার দিকে তাকালাম না, তাই বুঝতে পারলাম না তার চোখের দৃষ্টিতে ভয় বা ঘেন্না কোনটা আছে। ঘেন্না থাকাটাই স্বাভাবিক। আজকাল কেউ আমাকে দেখতে পারে না।
প্রথম পিরিয়ডে বাংলা। বাংলা স্যারের নাম তোফাজ্জল হোসেন সরকার ছেলেরা ডাকে তোফাজ্জল হোসেন রাজাকার সংক্ষেপে রাজাকার স্যার। এই নামের পিছনে একটা কারণ আছে, স্যারের ধারণা মুক্তিযুদ্ধের পুরো ব্যাপারটা ভুয়া, ইন্ডিয়া যুদ্ধ করে দেশটা দখল করে ফেলেছে। ক্লাসেও সেটা আকারে ইঙ্গিতে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। বাংলা বইয়ে বীরশ্রেষ্ঠদের গল্প পড়ার সময় স্যার ফাক ফাক করে হাসেন যেন পুরো বিষয়টা একটা তামাশা। রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলো ক্লাসে পড়ান না, কেউ সেটা নিয়ে প্রশ্ন করারও সাহস পায় না। বাংলাদেশের সাথে যখন পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা হয় তখনও এই স্যার বাংলাদেশকে সাপোর্ট না করে পাকিস্তানকে সাপোর্ট করেন।
ঘণ্টা পড়ার কিছুক্ষণ পর তোফাজ্জল হোসেন সরকার খাতাপত্র নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন। চুকে সবসময় স্যার সারা ক্লাসে একবার চোখ বুলিয়ে নেন, আজকেও চোখ বুলালেন এবং আমার পাশে এই নতুন মেয়েটিকে বসে থাকতে দেখে কেমন যেন চমকে উঠলেন। খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তু-তুমি এখানে কেন?
মেয়েটা বলল, আমি নতুন এসেছি স্যার।
মেয়েটা নতুন এসেছে, যেটুকু দেখেছি তাতে মনে হচ্ছে মাথায় একটু পাগলামোর ধাচ আছে তাই স্যারের প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারল না। স্যার আসলে জানতে চাচ্ছিলেন সে মেয়ে হয়ে ছেলেদের সাথে কেন বসেছে। স্যার রাজাকার টাইপের মানুষ, কোন ছেলে আর মেয়েকে কথা বলতে দেখলেই খুব বিরক্ত হন–ক্লাসে পাশাপাশি বসতে দেখলে তার তো মেজাজ খারাপ হতেই পারে। স্যার বললেন, নতুন এসেছ তো বুঝতেই পারছি। তা পিছনে বসেছ কেন? সামনে আস।
ইঙ্গিতটা একেবারে স্পষ্ট, মেয়ে হয়ে ছেলেদের সাথে পিছনে বসেছ কেন, সামনে চলে এসো। মেয়েটা ইঙ্গিতটা হয় বুঝতে পারল না কিংবা না বোঝার ভান করল, ফিক করে একটু হেসে ফেলে বলল, না স্যার। পিছনেই ভাল। আমি সব সময় পিছনে বসি।
স্যার বললেন, পি-পিছনে বসে?
জি স্যার।
কেন?
পিছনে বসলে সবাইকে দেখা যায়। খুব ইন্টারেস্টিং মনে হয়।
আমাদের রাজাকার স্যার মনে হয় কিছুই বুঝতে পারলেন না, খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর টোক গিলে বললেন, ইন্টারেস্টিং?
জি স্যার।
আস্তে আস্তে তার মুখটা মেঘের মতো কালো হলো, স্যার ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি স্কুলে কী পড়াশোনা করতে এসেছ না ইন্টারেস্টিং কাজ করতে এসেছ?
মেয়েটার চেহারায় একটা হাবা হাবা ভাব আছে কিন্তু মেয়েটা অসম্ভব চালু, স্যারের প্রশ্নের উত্তরে একটুও চিন্তা না করে সাথে সাথে বলল, ইন্টারেস্টিং উপায়ে পড়াশোনা করতে এসেছি স্যার।
মেয়েটার কথা শুনে ক্লাসের অনেকে খিকখিক করে হেসে ফেলল, স্যার তখন আরো রেগে গেলেন, ধমক দিয়ে বললেন, চোপ, সবাই চোপ।
সবাই চুপ করে যাবার পর স্যার তার রেজিস্টার খাতা খুলে গম্ভীর গলায় রোল নম্বর ডাকতে শুরু করলেন। নতুন মেয়েটার রোল নম্বর বাহান্ন, নাম প্রিয়াংকা।
রোল কল শেষ করে স্যার পড়াতে শুরু করলেন। ক্লাসের শুরুতেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে তাই আজকে আমাদের কপালে দুঃখ আছে। স্যার বই দেখে একটা প্যারাগ্রাফ শেষ করেই জয়ন্তকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। জয়ন্ত ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছাত্র, উত্তরটা ঠিকভাবে দিয়ে দিল, স্যার মনে হলো তখন আরেকটু রেগে গেলেন। আমরা ভাবলাম জয়ন্তকে আরো কঠিন একটা প্রশ্ন করবেন। জয়ন্তকে পড়াশোনার প্রশ্ন করে আটকানো খুব কঠিন, তবে রাজাকার স্যারের অসাধ্য কিছু নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত জয়ন্ত একটা ভুল উত্তর না দিচ্ছে স্যার প্রশ্ন করে যেতেই থাকবেন এবং তখন তাকে আচ্ছা মতন পেটাবেন–স্যার প্রায় সব ক্লাসেই হিন্দু ছেলেদের পেটান। কিন্তু আজকে জয়ন্তের কপাল ভাল, স্যার জয়ন্তকে ছেড়ে দিলীপকে ধরলেন। দিলীপের পড়াশোনায় একেবারে মন নেই, ক্লাসে এসে উদাস মুখে বসে থাকে। সে কী বুদ্ধিমান না বোকা সেটা আমরা এখনও ঠিকভাবে ধরতে পারি নাই। স্যারেরা কিছু জিজ্ঞেস করলে প্রশ্ন শেষ হবার আগেই মাথা নেড়ে বলে, জানি না। স্যার।