বাসা থেকে পালিয়ে যাবার শুধু একটা সমস্যা–সেটা খুব ভাবনাচিন্তা করে করা যায় না। কাজেই আমি ঠিক করলাম কোন একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাসা থেকে বের হয়ে যাব আর ফিরে আসব না। আমি মোটামুটি নিশ্চিত আমি বাসায় ফিরে আসি নাই বাসার কেউ সেটা অনেক দিন জানবে না। হয়তো দুলি খালা সেটা প্রথমে লক্ষ্য করবে, বাসায় বলার চেষ্টা করবে কিন্তু আম্মু শুনতে চাইবেন না। আম্মু যেহেতু শুনতে চাইবেন না তাই আপু আর ভাইয়াও কিছু করতে পারবে না, নিজেরা নিজেরা হয়তো এখানে সেখানে একটু খোঁজখবর নেবে তারপর হাল ছেড়ে দেবে। কয়দিন পরে আস্তে আস্তে সবাই ভুলে যাবে। আগে হলে এই পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে আমার ভয়ংকর একটা অভিমান হতো, আকজাল কিছুই হয় না। মানুষের ভেতর ভাল ভাল যেসব অনুভূতিগুলি থাকে আমার সেগুলি শুকিয়ে শেষ হয়ে গেছে। নিজের ভিতরে সেগুলি শেষ হয়ে গেছে বলে অন্যের ভেতরে সেগুলো থাকতে পারে সেটাও আমার আর বিশ্বাস হয় না। যাকেই দেখি তাকেই মনে হয় নিষ্ঠুর।
যেদিন বাসা থেকে পালাব ঠিক করলাম সেদিন একটু সকাল সকাল বের হয়েছি, সরাসরি রেল স্টেশনে গিয়ে কোন একটা ট্রেনের ছাদে গিয়ে বসব ঠিক করেছিলাম কিন্তু খানিক দূর গিয়ে মনে হলো শেষবারের মতো একবার স্কুল থেকে ঘুরে আসি। কেন সেটা মনে হলো কে জানে! একজন মানুষের জীবনে একটা ছোট ঘটনা সবকিছু ওলটপালট করে দেয় আমার সেদিনের স্কুলে যাবার ঘটনাটা ছিল সেরকম একটা ঘটনা, আমার জীবনের সবকিছু সেই ঘটনার জন্যে অন্যরকম হয়ে গেল।
ক্লাসরুমে জানালার কাছাকাছি একটা সিট আমার জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা আছে, সেখানে কেউ বসতে সাহস পায় না। আমাদের ক্লাসের ছেলেরা আর মেয়েরা একে অন্যের সাথে মিশে না, মেয়েরা সামনে কয়েকটা বেঞ্চে বসে, ছেলেরা বসে পিছনে। ছেলেরা পিছনে বসলেও শুধু যে আমার সিটে কেউ বসে না তা নয়, আমার পাশেও বসতে চায় না। কিন্তু সেদিন ক্লাসে গিয়ে দেখি আমার সিটে একজন বসে আছে। কোন একজন ডানপিটে ধরনের বা গাধা টাইপের ছেলে হলে কথা ছিল–যে বসে আছে সে একটা মেয়ে। নতুন এসেছে বলে কিছু জানে না। আমাদের ক্লাসের মেয়েগুলো অহংকারী ধরনের, কখনো হাসে না, সবসময় মুখ গম্ভীর করে থাকে। দেখলেই মনে হয় কেউ বুঝি তাদের আচ্ছা করে বকাবকি করেছে কিংবা ধরে জোর করে তেতো কোন ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে, সেই জন্যে মুখগুলো এরকম ভোঁতা! তবে এই মেয়েটা তাদের মতো না, সম্পূর্ণ অন্যরকম। মেয়েটার চোখে-মুখে হাসি, চোখগুলো কেমন যেন চকচক করছে। পিছনের ডেস্কে হেলান দিয়ে বসে এমনভাবে পা দুলাচ্ছে যে দেখে মনে হবে তার বুঝি খুব আনন্দ হচ্ছে। মেয়েটার আহ্লাদি ভাব দেখেই আমার মেজাজ একটু গরম হয়ে গেলো। আমি কাছাকাছি গিয়ে বললাম, সরো।
মেয়েটা পা দোলানো বন্ধ করে বলল, কোথায় সরব?
আমি মেঘের মতো গলায় বললাম, মেয়েরা সামনে বসে। ছেলেদের সাথে বসে না।
মেয়েটার হাসি হাসি মুখ এবারে একটু গম্ভীর হলো। বলল, ছেলেদের সাথে বসলে কী হয়?
আমি এখন তার সাথে একটা আলোচনা শুরু করে দেব সেটা তো হতে পারে না, তাই মুখ খিচিয়ে একটা ধমক দিয়ে বললাম, খবরদার বলছি, ভাদর ভ্যাদর করবে না। তোমাকে সরতে বলেছি সরো।
ক্লাসের অন্য যে কোন মেয়ে হলে আমার এই ধমক খেয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলতো, কিন্তু এই মেয়ের কিছু হলো না। আমার দিকে এমনভাবে তাকালো। যেন আমি খুব একটা মজার কথা বলেছি। তার মুখে হাসি হাসি ভাবটা ফিরে এলো এবং আবার সে পা দোলাতে শুরু করল। আমি আবার হুংকার দিলাম, কী হলো কথা কানে যায় না?
আমার ধমক শুনে ক্লাসের অন্য সবাই ঘুরে তাকিয়েছে, সোজাসুজি তাকাতে সাহস পাচ্ছে না তাই চোখের কোণা দিয়ে আমাকে দেখার চেষ্টা করছে। আমার মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো, আমি আবার মুখ-চোখ খিচিয়ে হাত নেড়ে হুংকার দিয়ে বললাম, এটা আমার সিট, এখান থেকে সরো।
আমি যখন এভাবে মুখ-চোখ খিঁচিয়ে হুংকার দিয়ে কথা বলি তখন কেউ আমার দিকে তাকাতেই সাহস পায় না কিন্তু এই মেয়ে একেবারে সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, চোখে ভয়-ডর তো নেই-ই উল্টো মনে হলো। কৌতুক। যেন আমি হাসির একটা নাটক করছি আর সে সেই নাটকটা খুব উপভোগ করছে। আমি টেবিলে থাবা দিয়ে আরেকটা ধমক দিতে যাচ্ছিলাম তখন মেয়েটা বলল, ঠিক আছে, আমি তোমাকে তোমার সিটে বসতে দেব কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
তুমি এরকম রাগ হয়ে কথা বলতে পারবে না। তোমাকে সুইট করে কথা বলতে হবে!
আমি একেবারে থতমত খেয়ে গেলাম। মেয়েটার নিশ্চয়ই পুরোপুরি মাথা খারাপ তা না হলে কেউ এভাবে কথা বলে? মেয়েটা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলো, তুমি বলো, প্লি-ই-জ তুমি এখান থেকে সরে বসো, তাহলে আমি তোমাকে তোমার সিট ছেড়ে দেব।
মেয়েটার কথার মাঝে কী ছিল কে জানে, আমাদের চারপাশে যারা দাড়িয়ে ছিল তাদের অনেকেই হি হি করে হেসে উঠল। আমাকে নিয়ে কেউ হাসলে আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না, আমার মাথায় একেবারে রক্ত চড়ে গেল। আমি তখন ডেস্কের ওপর রাখা মেয়েটার খাতা বই ব্যাগ টান দিয়ে ছুড়ে নিচে ফেলে দিয়ে বললাম, আমার সাথে ঢং করো? ঢং করো আমার সাথে?
মেয়েটা এবারে একটু অবাক হয়ে তাকালো, মাথা নেড়ে বলল, আমি আজকে প্রথম দিন তোমাদের স্কুলে এসেছি আর তুমি আমার সাথে এরকম ব্যবহার করলে? মেয়েটা নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে একটু অপেক্ষা করে বলল, আমি মনে খুব কষ্ট পেলাম।