আমি বললাম, কী আম্মু?
আম্মু ফিসফিস করে বললেন, তুই একটু সামনে দাঁড়া। তোকে দেখি।
আমি আম্মুর সামনে দাঁড়ালাম। আম্মু অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর ফিসফিস করে বললেন, আমি তোর ওপর অনেক অত্যাচার করেছি। তাই না?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না আম্মু করো নি।
আম্মু বললেন, করেছি। আমি জানি। আম্মু কেমন জানি ক্লান্ত হয়ে গেলেন। মনে হলো কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে একটু শক্তি সঞ্চয় করলেন, তারপর বললেন, তোর আব্বু মারা যাবার পর আমার যে কী হয়ে গেলো আমি জানি না। আমি তোকে সহ্য করতে পারতাম না তপু।
আমি আম্মুর আরেকটু কাছে এগিয়ে গেলাম। ভয়ে ভয়ে বললাম, আমি তোমার হাতটা একটু ধরি আম্মু?
ধরবি? ধর।
আমি আস্তে আস্তে আমার আম্মুর হাতটি ধরলাম, আহা! কী শুকনো আর ঠাণ্ডা হাত। হাতটা ধরেই আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। আম্মু স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, ফিসফিস করে বললেন, আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি তপু। অনেক কষ্ট।
না আম্মু দেও নাই।
দিয়েছি।
আমি আম্মুর হাতটা শক্ত করে ধরে রেখে বললাম, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন তুমি আমাকে কতো আদর করতে মনে আছে?
আম্মু মাথা নাড়লেন। তার মুখে হঠাৎ এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল। আহা! কতোদিন পর আমার আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমি ফিসফিস। করে বললাম, আমার শুধু সেই আদরের কথা মনে আছে। আর কিছু মনে নাই আম্মু।
আম্মু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, সত্যি?
সত্যি আম্মু।
আম্মু আমাকে তার দুর্বল হাত দিয়ে টানলেন, বললেন, আয় বাবা। আমার আরেকটু কাছে আয়।
আমি আম্মুর আরেকটু কাছে গেলাম। আম্মু আমাকে তার বুকের মাঝে টেনে নিলেন।
আহা! কতো দিন, কতো রাত, কতো যুগ থেকে আমি এই মুহূর্তটার জন্যে অপেক্ষা করেছিলাম! আমি দুই হাত দিয়ে আম্মুকে শক্ত করে ধরে রাখলাম। আমার শুধু মনে হতে লাগলো ছেড়ে দিলেই বুঝি আম্মু চলে যাবেন। খোদা! হেই খোদা–আমার আম্মুকে তুমি আমার কাছ থেকে নিয়ে যেয়ো না। তোমার দোহাই লাগে খোদা!
কিন্তু খোদা আমার কথা শুনলেন না। আমার আম্মু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখে মারা গেলেন।
বাইরে প্রিয়াংকা মৌটুসি শিউলী আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে বের হতে দেখে তারা এগিয়ে এলো। প্রিয়াংকা চোখের পানি মুছে নরম গলায় বলল, তপু।
আমি প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম। মা মারা গেলে একজন হাসে কেমন করে সেটা কেউ বুঝতে পারল না। আমি জানি তারা বুঝতে পারবে না। মা মারা গেছেন বলে তো আমি হাসছিলাম না। অনেক দিন পর শেষ পর্যন্ত আমি আমার মায়ের কাছে ফিরে গিয়েছিলাম বলে হাসছিলাম।
কেউ সেটা বুঝতে পারে নি। শুধু প্রিয়াংকা বুঝতে পেরেছিল। আমি দেখলাম শুধু সে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।
চোখে পানি আর ঠোঁটের কোণায় একটু হাসি–এটি কী বিচিত্র একটি দৃশ্য!