আম্মুর জ্ঞান ফিরবে কী না সেটা নিয়ে সবার ভেতরে সন্দেহ ছিল, কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আম্মুর জ্ঞান ফিরে এলো। আপু আর ভাইয়া যখন আম্মুর সাথে কথা বলে ফিরে এলো আমি জিজ্ঞেস করলাম, আম্মু কেমন আছেন?
আপু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আগের মতোই।
কথা বলেছেন আম্মু?
হ্যাঁ। একটু বলেছেন।
কী বলেছেন আম্মু?
আপু হাত নেড়ে উড়িয়ে দেবার মতো করে বলল, এই তো এটা সেটা।
আমি অনেক আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার কথা কিছু বলেছেন আম্মু?
আপু আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো, বলল, না। আম্মু তোর কথা কিছু জিজ্ঞেস করে নাই।
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে সরে এলাম। আমি একেবারে গোপনে একটা ছেলেমানুষী আশা করে বসেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম আম্মুর মাথায় সেই ভয়ংকর টিউমারটির জন্যে আম্মু আমাকে সহ্য করতে পারেন না। সেই টিউমারটি এখন কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে এখন হয়তো আম্মু আবার আগের মতো আমাকে ভালবাসবেন! আপুর কথা শুনে বুঝতে পারলাম সেটি সত্যি নয়। ঠিক কেন জানি না আমার বুকটা ভেঙ্গে গেলো অন্য রকম একটা কষ্টে।
ধীরে ধীর আম্মুর অবস্থা আরো খারাপ হলো। আমি দেখতে পারবো না জেনেও প্রত্যেক দিন এসে ঘরের বইরে বসে থাকতাম। ভাইয়া আর আপু ভেতরে গিয়ে আম্মুর সাথে একটু কথা বলে বের হয়ে আসতো, আমি তাদের কাছে জানতে চাইতাম আম্মু কেমন আছেন। তারা পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারতো না, দায়সারা কিছু একটা বলতো। আমি অপেক্ষা করতাম কখন আম্মু ঘুমাবেন তখন দূর থেকে তাকে গিয়ে দেখে আসতাম, শুধু ভয় করতো হঠাৎ যদি ঘুম ভেঙ্গে আমাকে দেখে রেগে যান তখন কী হবে? তাকে একবার হাত দিয়ে ছোঁয়ার জন্যে আমার সমস্ত শরীর আকুলি বিকুলি করতো। শুধু মনে হতো একবার যদি আম্মুর বুকের ওপর মাথা রেখে আম্মুর সাথে একটা কথা বলতে পারতাম! সাধারণ একটা কথা। সহজ একটা কথা!
ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পারলো আম্মু আসলে বাঁচবেন না। আম্মু বেশিরভাগ সময় জাগা এবং ঘুমের মাঝামাঝি একটা জায়গায় থাকেন। আজকাল মাঝে মাঝে আপু আর ভাইয়াকেও নাকী চিনতে পারেন না। সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারি না, তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে চাই আম্মু আমার কথা কিছু বলেছেন কী না। কিন্তু কখনোই বলেন না। আমি যে আছি সে কথাটাই যেন ভুলে গেছেন। আর কয়দিন পর আম্মু আর কাউকেই চিনবেন না। তখন কী হবে? আম্মুর জীবন থেকে আমি একেবারেই হারিয়ে যাব?
খুব মন খারাপ করে একদিন আমি হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ ডাক্তারদের সাদা গাউন পরা একজন ভদ্রমহিলা আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে আমি কোথায় দেখেছি?
আমি ইতস্তত করে বললাম, মনে হয় এইখানে। আমি প্রত্যেক দিন এখানে আসি।
উঁহু, এইখানে না। আমি তো এইখানে আগে আসি নাই। ডাক্তার ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ আমার দিকে তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে থাকলেন। হঠাৎ তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বললেন, মনে পড়েছে! তুমি চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন! গ্রেট ম্যাথমেটিশিয়ান!
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে বললেন, আমি আমার মেয়েকে সেই কম্পিটিশনে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মেয়ে তোমার অটোগ্রাফ নিয়েছিল।
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে বলল, ও।
তুমি এখানে কেন?
আমার আম্মুর মাথায় অপারেশন হয়েছে।
কতো নম্বর বেড।
সতেরো।
ভদ্রমহিলা আর কিছু না বলে ভিতরে ঢুকে গেলেন।
আমি একা একা বাইরে বসে আছি তখন দেখতে পেলাম সেই ডাক্তার ভদ্রমহিলা আবার বের হয়ে এসেছেন। আমাকে দেখে আবার আমার কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি কী তোমার মায়ের সাথে কথা বলতে চাও?
আমি তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লাম, বললাম, না-না।
ডাক্তার ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন, কেন না?
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ডাক্তার ভদ্রমহিলা বললেন, এসো ভেতরে এসো। একটু থেমে নরম গলায় বললেন, তোমার আম্মু এই সময়টাতে নিশ্চয়ই তার ছেলেমেয়েকে দেখতে চাইবেন।
আমি আস্তে আস্তে বললাম, আমার আম্মুর সামনে যাওয়া নিষেধ। আমাকে দেখলেই আম্মু রেগে যান।
ডাক্তার ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার আম্মুর আর রেগে ওঠার ক্ষমতাটুকু নেই খোকা! ভদ্রমহিলা আমার হাত ধরে বললেন, এসো আমার সাথে।
ভেতরে পাশাপাশি অনেকগুলো বেড়। আম্মুর বেডটা এক কোনায়, ডাক্তার ভদ্রমহিলা আমাকে আম্মুর বেডের কাছে নিয়ে গেলেন। আম্মু চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলেন পায়ের শব্দ শুনে চোখ খুলে তাকালেন। ডাক্তার ভদ্রমহিলা আম্মুকে বললেন, আপনার ছেলে আপনাকে দেখতে এসেছে। তারপর আমার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, তুমি তোমার আম্মুর সাথে কথা বলো। আমি আমার
পেশেন্টকে একটু দেখে আসি।
আম্মু কিছু না বলে আমার দিকে তাকালেন। আমি ও আম্মুর দিকে তাকালাম। আব্বু মারা যাবার পর আমি যতবার আম্মুর চোখে দিকে তাকিয়েছি ততবার আম্মুর চোখ ধ্বক করে জ্বলে উঠেছে, এই প্রথমবার আম্মুর চোখ ধ্বক করে জ্বলে উঠল না। আম্মু স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। খুব ধীরে ধীরে আম্মুর চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠলো। আম্মুর ঠোঁট দুটো হঠাৎ নড়ে উঠলো, কিছু একটা বলার চেষ্টা করছেন। আমি আম্মুর কাছাকাছি এগিয়ে গেলাম, শুনলাম আম্মু আমাকে ডাকলেন, তপু।