রাত্রিবেলা আমি দুলি খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, দুলি খালা? আম্মুর কী।
হয়েছে?
দুলি খালা অবাক হয়ে বলল, কী হবে? কিছু হয় নাই?
তাহলে আম্মু আজকাল এতো কম কথা বলে কেন?
তোমার আম্মু কুনোদিনই বেশি কথা বলে নাই–বলে দুলি খালা পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলো।
সেদিন রাত্রে আমি খুব সাহসের একটা কাজ করলাম, রাত্রিবেলা যখন সবাই নিজের নিজের ঘরে চলে গেছে তখন আমি পা টিপে টিপে আপুর ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। আপু আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো, ভুরু কুঁচকে ফিসফিস করে বলল,তপু?
হ্যাঁ, আপু।
কী হয়েছে?
আপু–আম্মুর কী হয়েছে?
আপু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো, বলল, কার?
আম্মুর।
কী হবে?
আম্মু কেমন জানি অন্যরকম ব্যবহার করছেন।
আপু তখনও আমার কথা বুঝতে পারছিলো না, মাথা নেড়ে বলল, কীরকম অন্যরকম ব্যবহার করছেন?
আমি বললাম, আমি জানি না।
আপু আমার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি কী করব বুঝতে না পেরে আমার স্টোররুমে ফিরে এলাম।
আমার সন্দেহটা যে সত্যি সেটা সপ্তাহখানেকের মাঝে সবাই বুঝতে পারলো। আম্মুর অফিসের গাড়ি এসেছে, অফিসে যাবার জন্যে আম্মু বের হবেন, হঠাৎ করে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে হাটু ভেঙ্গে পড়ে গেলেন। টেবিলের কোনায় মাথা লেগে মাথার বেশ খানিকটা কেটে গেলো। আম্মু যদিও উঠে বসে, আমার কিছু হয় নি, আমার কিছু হয় নি বলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলেন কিন্তু অন্যেরা তার কথা শুনলো না। তাকে ধরে একরকম জোর করে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। মাথায় ব্যথা পেয়েছেন বলে মাথার এক্সরে করে দেখতে পেলো মাথার ভেতরে একটা বড় টিউমার।
এর পরে সবকিছু কেমন যেন দ্রুত ঘটতে লাগলো। টিউমারটি মোটেও নিরীহ টিউমার না। এটাকে অপারেশন করতে হবে, অপারেশন করলেই যে আম্মু ভাল হয়ে যাবেন কোন ডাক্তার সেটাও দাবি করল না। আম্মু হাসপাতালে আছেন, প্রতিদিন বিকেলে ভাইয়া আর আপুর কাছে আম্মুর খবর শুনতে পাই।
যে সব বিষয়ে আম্মু বিচলিত হন সেগুলো না করার জন্যে ডাক্তারের কড়া নির্দেশ তাই আমার হাসপাতালে যাবার কোন প্রশ্নই আসে না। আমি তাই হাসপাতালে যেতে পারি না, আপু কিংবা ভাইয়া বাসায় এলে তাদের কাছে আম্মুর খবর নিই। খুব দ্রুত আম্মুর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যেতে লাগলো, আমাকে কেউ সেটা বলে দেয় নি কিন্তু আমি জানি আম্মুর মাথায় ভয়ংকর একটা অপারেশন হবে। শুধু অপারেশন হলে হবে না। তারপর কোন একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটতে হবে। শুধুমাত্র তাহলেই আম্মুকে বাঁচানো সম্ভব।
আম্মু বাসায় নেই বলে আমাকে স্টোররুমে বসে থাকতে হয় না। আমি মাঝে মাঝে বাসার ভেতরে হাঁটাহাঁটি করি। অনেক দিন পর আমি আম্মুর ঘরে গিয়েছিলাম। ড্রেসিং টেবিলের উপর তার পাউডার, লিপস্টিক পারফিউম সাজানো। চিরুনিতে আম্মুর দুই একটা চুল লেগে আছে। ওয়ারড্রোবের ভেতরে আম্মুর শাড়ি ব্লাউজ। বিছানায় গায়ে দেয়ার কম্বল ভাজ করে রাখা আছে, শুধু আম্মু নেই। দেওয়ালে আব্বু আর আম্মুর ছবি, বিয়ের পরপর তোলা, দুজনকেই দেখাচ্ছে খুব কম বয়সী, দুজনে এমনভাবে হাসছেন যে মনে হয় একটু খেয়াল করলে হাসির শব্দ শোনা যাবে।
বসার ঘরে বসে একদিন টেলিভিশন অন করেছি, কতোদিন টেলিভিশন দেখি না বলে জানি না আজকাল টেলিভিশনে কতো রকম নতুন নতুন চ্যানেল বের হয়েছে। কিছু কিছু খুব মজার আর কিছু কিছু এতো উদ্ভট যে মানুষজন কেমন করে দেখে সেটাই আমি চিন্তা করে পাই না। টেলিভিশন না দেখে না দেখে আমার টেলিভিশন দেখার অভ্যাস চলে গেছে তাই কিছুক্ষণ দেখার পরই আমার কেমন জানি বিরক্তি লাগতে থাকে। আমি টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়ে উঠে আসি। বাইরের ঘরে শেলফে অনেক বই। আমি বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখি কিন্তু মনের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা তাই কোন কিছু আর পড়তে ইচ্ছে করে না।
আম্মুর মাথার অপারেশন হলো দুই সপ্তাহ পরে। তাকে বিদেশে নেয়া হবে কী না সেটা নিয়েও একটু আলোচনা হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত মামা খালারা আপু আর ভাইয়ার সাথে কথা বলে এখানেই অপারেশন করবেন বলে ঠিক করলেন। যেদিন অপারেশন করা হবে সেদিন সকাল থেকে আমি হাসপাতালের বারান্দায় দাড়িয়ে রইলাম। যখন আম্মুকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায় তখন আপু আর ভাইয়া আম্মুর কাছে গিয়ে তার হাত ধরে রইলো। আমি দূরে একটা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম যেন আমাকে দেখতে না পান। হঠাৎ করে দেখে ফেললে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে।
অপারেশনটি শেষ হতে ছয় ঘণ্টা সময় নিলো, যারা অপারেশন করেন তারা টানা ছয় ঘণ্টা বিশ্রাম না করে কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন কে জানে। অপারেশন। থিয়েটার থেকে বের করে আম্মুকে একটা ঘরে নিয়ে রাখা হলো। আম্মুর জ্ঞান নেই বলে আপু আর ভাইয়ার সাথে আমিও দেখতে গেলাম। মাথার মাঝে ব্যান্ডেজ, নাক এবং মুখ থেকে প্ল্যাস্টিকের নল বের হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ এবং মুখ অল্প খোলা, নিঃশ্বাসের সাথে সাথে এক ধরনের শব্দ হচ্ছে, কেমন যেন অস্বস্তিকর একটি শব্দ, শুনলে বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে। শরীরের নানা জায়গা থেকে নানারকম তার বের হয়ে এসেছে, চারপাশে অনেক রকম যন্ত্রপাতি, সেগুলোতে অনেক রকম আলো, অনেক রকম শব্দ। আম্মুকে দেখে আমার কাছে একজন অচেনা মানুষ বলে মনে হতে লাগলো। আমাদের সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে দিলো না, একটু পরেই একজন নার্স এসে আমাদের বের করে নিয়ে এলো।