আমি শুনলাম প্রিয়াংকার আব্বু বলছেন, তোমাদের কেউ একজন আমাকে ধরে একটু নিচে নামিয়ে নিয়ে যাও, প্রিয়াংকার কাছে। প্লিজ।
হাসপাতালে নেয়ার পর যখন প্রিয়াংকাকে এক্সরে করা হচ্ছে তখন তার জ্ঞান ফিরে এলো। ডান হাতটা কনুইয়ের কাছে ভেঙ্গে গেছে সেটা প্লাস্টার করে দেয়া হলো। যেহেতু মাথায় ব্যথা পেয়েছে সে জন্যে তাকে হাসপাতালে আরো তিনদিন রাখা হলো চোখে চোখে রাখার জন্যে। যখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয় তখন আমরা অনেকে সেখানে ছিলাম। প্রিয়াংকার আব্রু যখন প্রিয়াংকাকে নিয়ে অনেক কষ্ট করে ক্যাবে উঠে তার হুইল চেয়ারটা ভাঁজ করে পিছনে রাখছেন তখন আমার দিকে তাকিয়ে কষ্ট করে একটু হেসে বললেন, বুঝলে ইয়ং ম্যাথমেটিশিয়ান, এ জন্যে আমি সব সময় সারপ্রাইজ পার্টিকে একটু ভয় পাই! সারপ্রাইজটা কোন দিক থেকে আসবে কেউ বুঝতে পারে না!
প্রিয়াংকার হাতের প্লাস্টার না খোলা পর্যন্ত আমরা সবাই পালা করে তার ক্লাস নোট লিখে দিয়েছি, হোমওয়ার্ক খাতায় তুলে দিয়েছি। স্কুলে টিফিনের সময়। যখন দরকার হয়েছে তাকে খাইয়ে দিয়েছি। প্রত্যেক দিন বিকালে তার স্কুলের ব্যাগ ঘাড়ে করে বাসায় পৌঁছে দিয়েছি। ক্লাসের সব ছেলেরা বলল তারা সবাই মিলে এক হাজার বার কান ধরে উঠ বোস করবে, প্রিয়াংকার মনটা নরম করতে এক হাজার বার করতে হয় নাই একশবার করার পরই সে সবাইকে মাফ করে দিয়েছে।
প্রিয়াংকা মাফ করে দিয়েছে সত্যি কিন্তু তার আব্বু আমাদের মাফ করছেন। কী না, কিংবা এখন না করলেও পরে কোন দিন মাফ করবেন কী না সেই বিষয়ে আমাদের সবারই খুব সন্দেহ রয়ে গেছে।
১১. ফেরা
আম্মুর কিছু একটা হয়েছে। কী হয়েছে আমি জানি না। সত্যি কথা বলতে কী কিছু একটা হয়েছে সেটা আমি কেমন করে জানি সেটাও আমি জানি না, কিন্তু আমি মোটামুটি নিশ্চিত আম্মুর কিছু একটা হয়েছে। অন্ধ মানুষেরা চোখে দেখতে পায় না বলে তারা সবকিছু শব্দ দিয়ে অনুভব করে। আমিও আসলে অন্ধ মানুষের মতো, আমি আম্মুকে দেখি না। আম্মুর সাথে আমার দেখা হয় যখন আম্মু আমাকে মারেন তখন। বাকি সময়টুকু আমি আম্মুকে অনুভব করি শব্দ দিয়ে। আমি স্টোররুমে আমার ছোট বিছানা থেকে আম্মুর প্রত্যেকটা শব্দ শুনতে পাই। আম্মু ঘুম থেকে উঠছেন, বাথরুমে যাচ্ছেন, জানালা খুলে বাইরে তাকাচ্ছেন, গুনগুন করে গান গাইছেন–আম্মুর প্রত্যেকটা শব্দ আমি খুঁটিয়ে খুটিয়ে শুনি। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখে হাসছেন, সিডিতে গান শুনছেন। কিংবা খাবার টেবিলে বসে ভাইয়া আর আপুর সাথে গল্প করছেন, সবকিছু শুনে শুনে সেগুলো আমার মাথার মাঝে গেঁথে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ যখন আমার সাথে দেখা হয়, এক মুহর্তে যখন রেগে আগুন হয়ে যান, তখন যখন হিংস্রভাবে আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়েন তখনও আমি বুঝতে পারি আম্মু কখন কী। করবেন।
অন্ধ মানুষের মতো শুধু শব্দ শুনে শুনে আমি গত তিন বছর আম্মুকে বোঝার চেষ্টা করেছি, তাই যখন স্টোররুমের কোনায় বসে হঠাৎ করে আম্মুর পরিচিত শব্দগুলো শুনতে পাই না তখন বুঝতে পারি আম্মুর কিছু একটা হয়েছে। খাবার টেবিলেও আম্মু আজকাল আগের মতো কথা বলেন না। অনেক সময় নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করেন। মাঝে মাঝে আমার আম্মুকে দেখার ইচ্ছে করে, কিন্তু আমি সাহস পাই না।
সেদিন রাত্রিবেলা আমি মিচকিকে হাতে নিয়ে তার সাথে ফিসফিস করে কথা বলছি এটা আমার আজকাল অনেকটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেছে, সারাদিন কী হয়েছে সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে বলি। আমি জানি শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় মিচকি আমার সব কথা বুঝতে পারে! কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমি একটু নিজের অজান্তেই একটু জোরে কথা বলে ফেলেছি। আম্মু কী কারণে রান্নাঘরে এসেছেন আমার গলার স্বর শুনে, নিঃশব্দে স্টোররুমে এসেছেন দেখতে আমি কার সাথে কথা বলছি।
আমি খেয়াল করি নি, হঠাৎ করে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি আম্মু দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন, অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার হাতের তালুতে মিচকি বসে ছিল, সেও তখন ঠিক আমার মতো অবাক হয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়েছে।
আম্মুর মুখটা ঘেন্নায় বাঁকা হয়ে গেলো, মুখ বিকৃত করে বললেন, তোর হাতে এটা কী?
আমি হাতটা নামিয়ে মিচকিকে লুকিয়ে ফেলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। আম্মু চিৎকার করে বললেন, ইঁদুর? তোর হাতে ইঁদুর?
আমি মিচকিকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সেটাকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলাম কিন্তু বোকা ইঁদুরটা সেটা বুঝলো না, মনে করলো সেটা আরেকটা খেলা, লাফিয়ে আমার হাত বেয়ে কাঁধে উঠে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মুকে দেখে মনে হলো বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। আমার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন, আমি জানি এখনই আম্মু চিলের মতো চিৎকার করে উঠবেন, তারপর হাতের কাছে যেটাই পান সেটা নিয়ে আমার ওপরে ঝাপিয়ে পড়বেন। কিন্তু আমি দেখলাম আম্মু কিছুই করলেন না, বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়েই থাকলেন।
আমি এতোটুকু শব্দ না করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম, আম্মুও আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর আমার মনে হতে লাগলো আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কিন্তু আমাকে দেখছেন না। আম্মু তখন ধীরে ধীরে তার মাথায় হাত দিলেন, তার মুখটায় যন্ত্রণায় একটা চিহ্ন ফুটে উঠল, সেইভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে টলতে টলতে কীভাবে জানি স্টোররুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি একটু পরে শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম আম্মু ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখে চুপচাপ নিঃশব্দে বসে আছেন। আমার খুব ইচ্ছে হলো আম্মুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, আম্মু তোমার কী হয়েছে? কিন্তু সাহস হলো না।