জি চাচা।
তাহলে তোমাদের সাথে শুক্রবারে দেখা হবে।
জি চাচা।
আপনি কিন্তু প্রিয়াংকাকে কিছু বলবেন না।
প্রিয়াংকার আব্বু হাসলেন, হেসে বললেন, আমি কিছু বলব না, তবে তোমরা ব্যাপারটা প্রকাশ করে দিও না। এসব ব্যাপারে প্রিয়াংকা কিন্তু খুব চালাক!
জি চাচা। আমরা জানি।
টেলিফোনটা রেখে আমি বুক থেকে একটা বড় নিঃশ্বাস বের করে দিলাম, আমার ওপর যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটা আমি অক্ষরে অক্ষরে করে ফেলেছি। এখন অন্যদের বাকি দায়িত্ব শেষ করতে হবে। দেখা যাক কী হয়!
সেদিন রাত্রিবেলা যখন মিচকি আমার সাথে দেখা করতে এলো আমি তাকে হাতে তুলে নিয়ে ফিসফিস করে বললাম, বুঝলি মিচকি, আগামী শুক্রবারে আমাদের বিশাল প্ল্যান।
মিচকি পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে প্ল্যানটা ভাল করে শুনতে চাইলো। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, প্রিয়াংকাকে একটা সারপ্রাইজ পার্টি দেব। সারপ্রাইজ পার্টি মানে বুঝেছিস? হঠাৎ করে একটা পার্টি দিয়ে চমকে দেওয়া।
রান্নাঘর থেকে দুলি খালা হঠাৎ করে স্টোররুমে উঁকি দিল, বলল, কী ব্যাপার? তুমি একলা একলা কার সাথে কথা বলো?
আমি তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে মিচকিকে আড়াল করে বললাম, কার সাথে কথা বলব আবার? নিজের সাথে কথা বলি?
দুলি খালা দাঁত বের করে হাসলো, বলল, এই বিষয়টা খারাপ না। নিজের সাথে নিজে কথা বললে কোন ঝগড়া-বিবাদ হয় না। তবে খালি একটা সমস্যা!
কী সমস্যা দুলি খালা?
অন্যেরা শুনলে তারা পাগল ভাবে! দুলি খালা হাসতে হাসতে আবার রান্নাঘরে চলে গেলো, আমি শুনলাম, বিড়বিড় করে সে নিজের সাথে কথা বলছে।
আমি মিচকিকে এক টুকরো রুটি ধরিয়ে দিয়ে বললাম, তাড়াতাড়ি খেয়ে পালিয়ে যা! দুলি খালা দেখলে তোর খবর আছে!
মিচকি দুই হাতে রুটির টুকরোটা ধরে গভীর মনোযোগ দিয়ে খেতে শুরু করলো।
শুক্রবার দিন দুইটা বাজার আগেই আমি প্রিয়াংকার বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। বাসার ভিতরে এখন ঢোকা যাবে না তাই কাছাকাছি একটা শপিং মলের ভেতরে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। একটু পরে পরে বাইরে গিয়ে তার বাসার দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করি প্রিয়াংকাকে তার আব্বু বাসা থেকে বাইরে পাঠিয়েছেন কী না। আড়াইটার বেশ আগেই আমাদের ক্লাসের আরো অনেকেই চলে এসেছে। সবার হাতেই কোন না কোন ধরনের ব্যাগ না হয় প্যাকেট। আমরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গা ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে রইলাম, একজন শুধু প্রিয়াংকার বাসার দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো।
আড়াইটা বাজার আগেই আমরা দেখলাম প্রিয়াংকা তার বাসা থেকে বের হয়েছে। তার পিঠে একটা ব্যাগ, হাতে একটা কাগজ। কাগজটা পড়ে সেটা ব্যাগে রেখে সে এদিক সেদিক তাকিয়ে রাস্তায় নেমে একটা রিকশা নিলো। রিকশাটা চলে যাবার সাথে সাথেই আমরা চারিদিক থেকে বের হয়ে, প্রায় দৌড়ে প্রিয়াংকার বাসায় চলে এলাম। সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো। প্রিয়াংকার আব্বু তার হুইল চেয়ারে বসে একটা খবরের কাগজ পড়ছিলেন। প্রিয়াংকার আব্বু যে হুইল চেয়ারে থাকেন সেটা আগেই সবাইকে বলে রেখেছিলাম তাই সবাই সেটা স্বাভাবিক ভাবে নিল। প্রিয়াংকার আব্বু আমাদের দেখে বললেন, তোমরা এসে গেছ তাহলে?
আমি বললাম, জি চাচা।
প্রিয়াংকার আলু বললেন, তোমাদের হাতে আধা ঘণ্টা সময়। আমি প্রিয়াংকাকে পাঠিয়েছি একটা ওষুধ কিনে আনতে ফার্মেসি থেকে, কিন্তু আধা ঘণ্টার মাঝে চলে আসবে।
জয়ন্ত বলল, আধা ঘণ্টার মাঝেই সবাই চলে আসবে, আংকেল।
জয়ন্তের কথা হবার আগেই মৌটুসি আর নীলিমা একটা হারমোনিয়াম আর কিছু পোঁটলাপুটলি নিয়ে ঢুকলো। তাদের পিছু পিছু আরো কয়েকজন। এবং আরো কিছুক্ষণের মাঝে আরো অনেকে। দেখতে দেখতে প্রায় সবাই চলে এসেছে–প্রিয়াংকার আব্বু আমাদের কাজ করতে দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন।
নাঈমা রঙিন কাগজ কেটে লিখে এনেছে জয় হোক প্রিয়াংকার সেটা দেওয়ালে লাগানো হলো। বেলুন ফুলিয়ে ফুলিয়ে ঘরের নানা জায়গায় ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখা হলো। মৌটুসি-নীলিমা আর তার দলবল হারমোনিয়াম নিয়ে রেডি। আদনান, ইশতিয়াক মামুন আর জয়ন্ত তাদের নাটকের জন্যে রেডি। আদনান এবং ইশতিয়াক হবে সন্ত্রাসী, মামুন পুলিশ অফিসার আর জয়ন্ত পথচারী। সন্ত্রাসী আদনান এবং ইশতিয়াকের হাতে অস্ত্র, তাদের চেহারা বিদঘুটে, পুলিশ অফিসার মামুন নকল গোঁফ লাগিয়েছে, পথচারী জয়ন্ত হাবাগোবা সেজে বসে আছে।
শিউলি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে, প্রিয়াংকাকে দেখলেই আমাদের সতর্ক করে দেবে। আমরা তখন সবাই দরজার কাছে চলে আসব।
তিনটা বাজার সাথে সাথেই প্রিয়াংকার জন্যে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। আমাদের সাথে প্রিয়াংকার আব্বুও আছেন, মুখে হালকা একটা দুশ্চিন্তা নিয়ে তার হুইল চেয়ারে বসে আছেন। ঠিক তিনটা দশে প্রিয়াংকাকে রিকশা করে আসতে দেখা গেলো, শিউলি চাপা গলায় বলল, প্রিয়াংকা আসছে! সবাই রেডি!
আমরা সবাই তখন দরজার কাছে ভিড় করে দাঁড়ালাম। উত্তেজনায় আমাদের বুক ধুকপুক করছে, শুনতে পাচ্ছি সে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। দরজার সামনে দাঁড়ালো, তারপর দরজায় শব্দ করলো। আদনান টান দিয়ে দরজা খুলে ফেললো আর আমরা সবাই বিকট গলায় চিৎকার করে উঠলাম, সা-র-প্রা-ই-জ!!
তারপর যে ঘটনা ঘটলো আমরা তার জন্যে একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না। প্রিয়াংকা ভয়ানক চমকে লফিয়ে পিছিয়ে সরে যেতে গিয়ে পা বেঁধে পড়ে গেলো। আমরা দেখলাম সে সিড়িতে একেবারে মাথা উল্টে পড়ে গেছে, দেওয়ালে জোরে তার মাথা লেগেছে এবং সেভাবে গড়িয়ে পড়ে যেতে যেতে সিঁড়ির নিচে সে আটকে গেলো। একটা হাত তার শরীরের নিচে এমন অস্বাভাবিকভাবে ঢুকে আছে যে দেখলেই বোঝা যায় হাতটা নিশ্চয়ই ভেঙ্গে গেছে। আমরা বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, প্রিয়াংকা নিথর হয়ে পড়ে আছে নড়ছে না। ভয়ে-আতংকে আমার হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ করে যেন থেমে গেলো।