কেন? চোখে কী হয়েছে?
চোখগুলি জ্বলে তুমি দেখ নাই? তুমি খুব সাবধান বাবা–আমার কেন জানি মনে হয় কোন একদিন তোমার মা তোমারে খুন করে ফেলার চেষ্টা করবে।
শুনে আমার শরীর কেঁপে উঠলো। দুলি খালা তখন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলতো, তোমার বাপ মরে যাবার পর তোমাদের এই সংসারটা ছারখার হয়ে গেছে। এইখানে আমার মন টিকে না বাবা। একেবারে ভাল লাগে না। তবু আমি এইখানে আছি–কেন আছি জানো?
কেন দুলি খালা?
তোমার জন্যে। খালি তোমার জন্যে। তোমার ভাই আর বইন তোমারে রক্ষা করতে পারবে না। আমি না থাকলে তুমি না খায়া মারা যাইবা। বুঝেছ?
আমি মাথা নাড়ি। দুলি খালা বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তোমার মায়ের উপর কুনো রাগ রাইখ না বাবা। তোমার মা আসলে পুরাপুরি পাগল। সে কী করতাছে সে জানে না। তারে আসলে পাগলাগারদে রাখা দরকার। তার চিকিৎসা হওনের দরকার। তারে তাবিজ-কবজ দেওয়া দরকার।
দুলি খালাই আসলে সত্যিকার ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল, আস্তে আস্তে আমি নিজেই বুঝতে পেরেছিলাম আব্বু মারা যাবার পর সত্যি সত্যি আমার আম্মুর মাথার ভিতরে কিছু একটা গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। তার চিকিৎসা করানোর দরকার ছিল, কিন্তু আমাকে সহ্য করতে না পারা ছাড়া আর কোন সমস্যা ছিল না দেখে সেটা বাইরের কেউ কোন দিন বুঝতে পারে নি। দুলি খালা বলেছিল আম্মু আমাকে খুন করে ফেলতে পারে, আমি সেটা কখনো বিশ্বাস করতে পারি নি। কিন্তু সত্যি সত্যি একদিন একেবারে অকারণে রেগে উঠে আম্মু আমার মাথা বালতির পানিতে চেপে ধরেছিলেন। দুলি খালা। রীতিমতো ধস্তাধস্তি করে আমাকে ছুটিয়ে না আনলে হয়তো সেদিন মরেই যেতাম। সেই থেকে আমি খুব সাবধান হয়ে গেছি। আম্মু যদি বাসায় একা থাকেন আমি বাসার ভিতরেই ঢুকি না। যতদিন আব্বু বেঁচে ছিলেন গায়ে হাত তোলা দূরে থাকুক কেউ আমার সাথে গলা উঁচু করেও কথা বলে নি। এখন সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার, একেবারে অকারণে আম্মু আমাকে মারধর করেন। ছোটখাটো চড়-থাপ্পড় নয় একেবারে অমানুষিক মার। প্রথম প্রথম আপু, ভাইয়া কিংবা দুলি খালা আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতো কিন্তু তাহলে আম্মু আরো রেগে যান বলে আজকাল আর কেউ চেষ্টা করে না। আমি দাতে দাত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করতে শিখে গেছি। মার খাওয়ার যন্ত্রণাটুকু নয় এর পিছনের নিষ্ঠুরতাটুকু আমাকে অনেক বেশি কষ্ট দেয়।
কয়দিনের ভিতরেই আমি রান্নাঘরে স্টোররুমে ঘুমানো শুরু করলাম। আমার পরিচিত মানুষেরা এটা শুনলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হতো কিন্তু ততদিনে আমার বাসার সবাই এটা মেনে নিয়েছে। আমি যদি আগের মতো ভাইয়ার ঘরে ঘুমাই তাহলে প্রায় প্রত্যেক রাত্রেই আম্মুর কোন একরকম অত্যাচার সহ্য করতে হয়। আম্মু এমনিতে ভাল মানুষ শুধু আমাকে দেখলেই খেপে যান। তাই সমস্যাটার সবচেয়ে ভাল সমাধান হচ্ছে যেন কোন সময়েই আমাকে দেখতে না। পান। বাসায় এসে আমি তাই রান্নাঘরের স্টোররুমে ঢুকে যেতাম। চালের বস্তা, আলুর টুকরি, তেল-পেঁয়াজ সরিয়ে দুলি খালা আমাকে শোয়ার একটা জায়গা করে দিল। আমি রাত্রেবেলা সেখানে ঘুমাতাম। বাসার সবাই বিষয়টা জানতো কিন্তু এমন ভান করতো যেন জানে না। আপু আর ভাইয়া যখন আমার দিকে তাকাতো আমি বুঝতে পারতাম আমার জন্যে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না। আমি আস্তে আস্তে আবিষ্কার করলাম এক সময়ে তারাও পুরো ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেলো, ধরেই নিল আমি রান্নাঘরের স্টোররুমে চালের বস্তার পাশে আলু বেগুন পেঁয়াজ আর রসুনের পাশে গুটিশুটি মেরে ঘুমাব। আগে পড়াশোনার একটা ব্যাপার ছিল এখন সেটাও নাই, খাতা কলম বই পত্র না থাকলে মানুষ পড়াশোনা করে কেমন করে? ধীরে ধীরে পড়াশোনাটাও প্রায় বন্ধ হতে শুরু করল। স্কুলের ছেলেমেয়েরা আর স্যারম্যাডামেরা ধরে নিলো আব্বু মারা যাবার পর আমি আস্তে আস্তে বখে যেতে শুরু করেছি। আমার শরীরে আম্মুর মারের যেসব চিহ্ন থাকতো সবাই ধরে নিতে শুরু করল সেগুলো এসেছে মারামারি করে! আস্তে আস্তে সবাই আমাকে ভয় পেতে শুরু করলো। আমার দুই চারজন যে বন্ধুবান্ধব ছিল তারাও আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে শুরু করল।
আমি হয়ে গেলাম একা। একেবারে একা।
০২. প্রিয়াংকা
এরকম সময়ে আমি ঠিক করলাম আমি বাসা থেকে পালিয়ে যাব। আগেই করা উচিত ছিল, কেন করি নাই সেটা ভেবেই আমার অবাক লাগল। আত্মহত্যা করার বিষয়টা অনেকবার চিন্তা করেছি কিন্তু বাসা থেকে পালানোর কথা একেবারেই চিন্তা করি নাই। আত্মহত্যা করার সাহস হয় নাই কিন্তু বাসা থেকে পালানোর বিষয়টা আমার কাছে খুব সহজ মনে হতে লাগলো। রান্নাঘরের স্টোররুমে তেলাপোকা আর ইঁদুরের মাঝখানে আমি যদি ঘুমাতে পারি তাহলে রাস্তাঘাটে-ফুটপাথে কিংবা রেল স্টেশনে ঘুমাতে অসুবিধা হবে কেন? আমি কল্পনা করতে শুরু করলাম সবাইকে ছেড়েছুড়ে বহুদূরে কোথাও চলে গেছি–কোন পাহাড়ের কাছে কিংবা সমুদ্রের তীরে। একা একা সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কেউ আমাকে কিছু বলছে না, ঘেন্না করছে না, বকাবকি করছে না, মারধর করছে না। বহুদিন আগে যখন আমি টেলিভিশন দেখতে পারতাম তখন টেলিভিশনে একবার বেদেদের ওপরে একটা অনুষ্ঠান দেখেছিলাম, তারা সবাই মিলে নৌকায় নৌকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নৌকায় তাদের ঘরবাড়ি, নৌকায় তাদের সংসার, নৌকায় তাদের সবকিছু। খুঁজে খুঁজে এরকম বেদে নৌকা খুঁজে বের করে তাদের সাথে চলে যাব। আমিও বেদে হয়ে যাব।