আমি ভিতরে ঢুকলাম। প্রিয়াংকার আবু তার হুইল চেয়ারটি ঘুরিয়ে ঘরের ভেতরে যেতে যেতে বললেন, বসো তপু। প্রিয়াংকা তো এখনো বাসায় আসে নাই, তার আসতে দেরি হয়।
জানি! আমি ইতস্তত করে বললাম, আমি আসলে আপনার কাছেই এসেছি।
আমার কাছে?
জি।
কী ব্যাপার?
ইয়ে মানে আমি বলছিলাম কী–এ্যাঁ এ্যাঁ–প্রিয়াংকার আব্লু খুব ধৈর্য ধরে মুখে হাসি ফুটিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। আমি শেষ পর্যন্ত বললাম, আমাদের ক্লাসের সবাই ঠিক করেছে যে প্রিয়াংকার জন্যে একটা সারপ্রাইজ পার্টি দেবে।
তাই নাকী! কী উপলক্ষে?
কোন উপলক্ষ না। এমনিই।
এমনিতেই সারপ্রাইজ পার্টি?
জি। প্রিয়াংকার আব্লু হেসে বললেন, তা আমাকে কী করতে হবে?
সবাই মিলে ঠিক করেছে পার্টিটা এইখানে হবে।
এইখানে? এবারে প্রিয়াংকার আব্বুর মুখে খুব হালকা মতোন একটু দুশ্চিন্তা উঁকি দিল। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি তিনি দুশ্চিন্তাটা লুকিয়ে ফেললেন।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আপনার কিছুই করতে হবে না। সব আমরা করব। আমরা খাবারদাবার নিয়ে আসব। একটা গানের অনুষ্ঠান হবে।
গানের অনুষ্ঠান? মনে হলো আবার তাঁর মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়লো। এবারে ঠিক হালকা দুশ্চিন্তার ছাপ নয় বেশ গভীর।
আমি বললাম, জি। আমাদের ক্লাসের কয়েকজন খুব সুন্দর গান গাইতে পারে। কয়েকজন একটা নাটকও করতে চাইছে।
না-নাটক? এবারে প্রিয়াংকার আব্বুর মুখে আরও বেশি দুশ্চিন্তার ছাপ পড়লো, সেটা ঠিক লুকানোর চেষ্টাও করলেন না। আমতা আমতা করে বললেন, ইয়ে আমি বলছিলাম কী, সারপ্রাইজ পার্টি সাধারণত সারপ্রাইজ থাকে না। তার চেয়ে একটা সাধারণ পার্টি করলে ভাল হয় না? খুব সিম্পল। তোমরা সবাই আসলে আমি আর প্রিয়াংকা মিলে তোমাদের জন্যে একটু চানাস্তা রেডি করলাম–
উঁহুঁ। আমি মাথা নেড়ে বললাম, ক্লাসের ছেলেমেয়েরা রাজি হবে না।
প্রিয়াংকার আকু চিন্তিত মুখে বললেন, রাজি হবে না?
নাহ! আমি মুখটা গম্ভীর করে বললাম, সবাই প্রিয়াংকাকে খুব পছন্দ করে তো–তাই তার জন্যে একটা সারপ্রাইজ পার্টি দিতে চায়।
প্রিয়াংকার আব্বু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে! তাহলে তো করতেই হয়।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, জি। আমাকে কী করতে হবে?
কিছু করতে হবে না। আমি ভরসা দিয়ে বললাম, আমরা সবাই আগেই এসে বাসায় সব কিছু রেডি করে ফেলব। তারপর সবাই লুকিয়ে থাকব। প্রিয়াংকা যেই আসবে।
প্রিয়াংকার আব্বু মাথা নাড়লেন, বললেন, বুঝেছি। তোমরা আমাকে আগে জানিয়ে দাও, কবে আসবে, কখন আসবে।
জি। জানিয়ে দেব।
প্রিয়াংকার আব্বুল্লুকে একটু মনমরা দেখালো, বললেন, তোমাকে কী খেতে দেব বলো। ভাল বিস্কুট আছে–
না চাচা। আমি মাথা নেড়ে বললাম, প্রিয়াংকা এসে আমাকে দেখলে সব বুঝে ফেলবে।
তা ঠিক।
আমি যাই চাচা।
ঠিক আছে।
আপনি কিন্তু প্রিয়াংকাকে বলবেন না কিছু।
না। বলব না।
আমি তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়ে এলাম।
পরের দিন যখন সবাইকে বলেছি যে সারপ্রাইজ পার্টি করার জন্যে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি তখন সবাই বেশ অবাক হলো। তারা কেউ চিন্তাও করে নাই যে আমি এতো তাড়াতাড়ি প্রিয়াংকার বাসায় গিয়ে তার আব্বুর সাথে কথাবার্তা বলে সব ঠিক করে ফেলব। প্রথমে তারা বিশ্বাস করতে চাইলো না কয়েকবার কিরা-কসম কাটার পর শেষ পর্যন্ত সবাই বিশ্বাস করল।
কাজেই সবাই মিলে এখন পরের অংশটুকু করার জন্যে রেডি হতে লাগলো। ক্লাস-কবি জহুরুলকে দায়িত্ব দেয়া হলো প্রিয়াংকাকে নিয়ে একটা গান লেখার। গান লেখার পর মৌটুসি আর নীলিমা সেটাতে সুর দিলো। গানটার শুরু এরকম :
আমাদের ক্লাসে আছে ছটফটে মেয়ে
দিন কাটে আনন্দে নেচে গান গেয়ে
প্রিয়াংকা সে যে প্রিয়াংকা…
আদনান, ইশতিয়াক, মামুন, জয়ন্ত তারা মিলে একটা নাটক দাঁড় করাচ্ছে। আমাকেও অভিনয় করতে বলেছিল, আমি রাজি হইনি। আমি ভাল করে কথাই বলতে পারি না, অভিনয় করব কীভাবে? সবার কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়েছে। সেগুলো দিয়ে কিছু উপহার কেনা হবে খাবার-দাবার কেনা হবে। কী খাওয়া হবে সেটা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক করে ঠিক করা হলো কাবাব এবং পরাটা কিনে আনা হবে। তার সাথে পেপসি। যদি টাকা-পয়সা দিয়ে কুলানো যায় তাহলে দুই কেজি মিষ্টিও কিনে আনা হবে। সারপ্রাইজ পার্টি করার জন্যে বাসাটাকে সাজাতে হবে। রঙিন কাগজ এবং বেলুন দিয়ে সাজানোর জন্যে আমাদের ক্লাস শিল্পী নাঈমাকে দায়িত্ব দেয়া হলো। পুরো ব্যাপারটা করতে হবে ছুটির দিনে, তাই উৎসাহে সবাই। ছটফট করতে থাকলেও পরের শুক্রবার দুপুর বেলার আগে সময় ঠিক করা গেলো না। আমি সেটা প্রিয়াংকার আব্বুকে জানানোর জন্যে তাকে ফোন করলাম। ফোন ধরে প্রিয়াংকার আব্বু বললেন, হ্যালো।
আমি বললাম, চাচা, আমি তপু।
ও! কী খবর ম্যাথমেটিশিয়ান।
জি ভাল। প্রিয়াংকা আশেপাশে নাই তো?
না। একটু বাইরে গেছে।
চাচা, আমরা শুক্রবার বিকালবেলা টাইম ঠিক করেছি।
গুড। আমার কিছু করতে হবে?
না চাচা কিছু করতে হবে না। শুধু—
শুধু কী?
প্রিয়াংকাকে আধা ঘন্টার জন্যে যদি বাসা থেকে কোথাও পাঠাতে পারেন তাহলে খুব ভাল হয়।
প্রিয়াংকার আব্বু এক মুহূর্ত কী একটা ভাবলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, আমি কোন কাজে প্রিয়াংকাকে আধাঘণ্টার জন্যে বাইরে পাঠিয়ে দেব।
থ্যাংক ইউ চাচা।
কয়টার সময় বাইরে পাঠাব?
আড়াইটার সময়। ঠিক আছে। তাহলে আড়াইটা থেকে তিনটার জন্যে তাকে বাইরে পাঠাব। তোমাদের এর মাঝে চলে আসতে হবে।