আশেপাশে যারা ছিলো তারা সবাই ঘুরে মুশফিকের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো, সবাই কখনো না কখনো এই কথাটা ভেবেছে। ক্লাসের সবচেয়ে লাজুক এবং মুখচোরা শিউলি বলল, হ্যাঁ, আমাদের সবাই মিলে প্রিয়াংকার জন্যে কিছু একটা করা উচিত।
জয়ন্ত মাথা নাড়ল, বলল, সবাই মিলে। সবাই শব্দটাতে সে আলাদা ভাবে জোর দিলো।
আমি একটু অবাক হয়ে দেখলাম আশেপাশে যারা ছিল তারা সবাই কাছাকাছি জড়ো হয়ে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করল। প্রিয়াংকা এর মাঝে কার জন্যে কী করেছে সেটা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়ে গেলো–আমার হয়তো সবচেয়ে বেশি কথা বলা উচিত ছিলো কিন্তু আমি চুপ করে বসে অন্যদের কথা শুনতে লাগলাম। প্রিয়াংকার জন্যে কী করা যায় সে ব্যাপারে ছেলেরা এবং মেয়েরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলো। মোটাসোটা আদনান বলল প্রিয়াংকাকে নিয়ে আমাদের কোথাও চাইনিজ না হলে পিতজা খেতে যাওয়া উচিত। সব ছেলেরা জোরে জোরে মাথা নেড়ে সেই প্রস্তাবে সম্মতি দিল। মৌটুসি বলল প্রিয়াংকার জন্যে আমাদের একটা গানের অনুষ্ঠান করা উচিত এবং সব মেয়েরা সেই প্রস্তাবে ছেলেদের থেকেও জোরে জোরে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। ছেলেদের এবং মেয়েদের মাঝে একটা বাগড়া শুরু হয়ে যাবার অবস্থা ঠিক তখন প্রিয়াংকা ক্লাসে হাজির হলো বলে ঝগড়াটা বেশি দূর গড়াতে পারল না।
পরের দিন যখন প্রিয়াংকা আশে-পাশে নেই তখন আবার আগের আলোচনা শুরু হলো–জয়ন্ত চাইনিজ কিংবা গানের অনুষ্ঠান এই দুটো কোনটাতেই না গিয়ে বলল, আমাদের করা উচিত একটা সারপ্রাইজ পার্টি।
আদনান ভুরু কুঁচকে বলল, সারপ্রাইজ পার্টি?
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। সেখানে তোর খাওয়া-দাওয়াও থাকতে পারে আবার ধর গান-বাজনাও থাকতে পারে।
প্রস্তাবটা অনেকের মনে ধরল। মৌটুসি জিজ্ঞেস করল, কোথায় হবে সারপ্রাইজ পার্টি?
মামুন বলল, এই ক্লাসেই করতে হবে।
আদনান বলল, ক্লাসে? ক্লাসে খাওয়া-দাওয়াটা হবে কেমন করে?
মৌটুসি বলল, গান-বাজনা করতে হলে হারমোনিয়াম তবলা লাগবে না? ক্লাসে সেটা আনবি কেমন করে?
আদনান বলল, আর যদি আনাও হয় সেটা তাহলে সারপ্রাইজ থাকবে না। প্রিয়াংকা বুঝে যাবে।
শিউলি বলল, হ্যাঁ। মনে নাই সে একবার আমার জন্মদিনে আমাকে সারপ্রাইজ দিল?
সেটি সত্যি, সারপ্রাইজ পার্টি দেওয়ার নিয়মকানুন প্রিয়াংকাই সবচেয়ে ভাল জানে! তাকে সারপ্রাইজ করা মনে হয় খুব সোজা না। ক্লাসে তাকে সারপ্রাইজ করতে হলে মনে হয় সে তো সারপ্রাইজ হবেই না, উল্টো আমরা সারপ্রাইজ হয়ে যাব।
আমাদের মাঝে দিলীপ কথাবার্তা কম বলে, সেটা তার বেশি বুদ্ধির লক্ষণ না কম বুদ্ধির লক্ষণ সেটা আমরা এখনো জানি না। পড়াশোনার ব্যাপারে সে যে খুব ঢিলে সেটা আমরা সবাই জানি কিন্তু অন্য বিষয়ে সে কী রকম তার পরীক্ষা কখনো হয় নি। সে হাই তুলে বলল, আসলে এইটা করতে হবে প্রিয়াংকার বাসায়।
আমরা সবাই অবাক হয়ে বললাম, প্রিয়াংকার বাসায়?
দিলীপ মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।
মৌটুসি জানতে চাইল, সেটা কীভাবে করবি?
তা আমি জানি না। বলে দিলীপ হেঁটে হেঁটে চলে গেলো।
প্রথমে কেউ দিলীপের কথাটা গুরুত্ব দিয়ে নেয় নাই কিন্তু সবাই যখন ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা চিন্তা করলো তখন বুঝতে পারল, সেটাই সবচেয়ে সঠিক জায়গা। সকালবেলা প্রিয়াংকা যখন বের হয়ে যাবে তখন আমরা সবাই সবকিছু নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে যাব। সবকিছু চটপট রেডি করে ফেলব তারপর প্রিয়াংকা যখন ফিরে আসবে তখন চিৎকার করে বলব, সারপ্রাইজ সাথে সাথে পার্টি শুরু হয়ে যাবে এবং সেটা হবে একেবারে ফাটাফাটি পার্টি! কিন্তু সমস্যা একটাই, আমরা সবাই মিলে প্রিয়াংকার বাসায় ঢুকবো কেমন করে? সেটা নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে তখন মৌটুসি আমার দিকে তাকালো এবং তাকিয়েই রইলো। আমি বললাম, আমার দিকে তুই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
মৌটুসি বলল, তুই।
আমি? আমি কী?
তুই ব্যবস্থা করবি।
আমি কীসের ব্যবস্থা করব?
কেমন করে প্রিয়াংকার বাসায় যাওয়া যায়।
আমি ইতস্তত করে বললাম, আমি কেন?
তা না হলে কে? প্রিয়াংকা তোর জন্যে কী করেছে তুই জানিস?
সত্যি কথা বলতে কী প্রিয়াংকা আমার জন্যে কী করেছে সেটা অন্যেরা কিছুই জানে না। অন্যেরা শুধু জানে গণিত কম্পিটিশনে আমাকে নিয়ে যাবার অংশটুকু! বাকিটুকু শুধু জানি আমি। আমি বললাম, হ্যাঁ, জানি?
তাহলে? এবারে মৌটুসির সাথে অন্যেরাও যোগ দিলো। জয়ন্ত বলল, তোর মাঝে কৃতজ্ঞতা বলে কিছু নাই? মামুন বলল, তুই প্রিয়াংকার জন্যে কিছু করতে চাস না? আদনান বলল, প্রিয়াংকা তোর জন্যে যেটা করেছে সেটা কী অন্য কেউ করতো?
আমি বললাম, হ্যাঁ, তা ঠিক আছে, কিন্তু
কোন কিন্তু নাই। শিউলির মতো মুখচোরা লাজুক মেয়েটা পর্যন্ত হাত তুলে আমাকে ধমক দিয়ে বলল, তোমাকেই ব্যবস্থা করতে হবে।
আমি মাথা চুলকে বললাম, কিন্তু-মানে-আমি-ইয়ে-বলছিলাম কী—তাহলে–
কাজেই কেউ আমার কথা শুনলো না।
আমি কী করব বুঝতে না পেরে পরের দিনই স্কুল ছুটির পর প্রিয়াংকাদের বাসায় হাজির হলাম। প্রিয়াংকা সরাসরি বাসায় যায় না, দুনিয়া ঘুরে নানা জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে আনন্দ বিতরণ করে তারপর বাসায় ফিরে আসে। আমি দরজায় শব্দ করলাম, কিছুক্ষণ পর খুট করে শব্দ করে প্রিয়াংকার আব্বু দরজা খুলে দিলেন। আমাকে দেখে একটু অবাক হলেন কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না, বললেন, আরে আমাদের ম্যাথমেটিশিয়ান দেখি! এসো এসো।