আমি এই প্রশ্নের কী উত্তর দেব সেটা বুঝতে পারলাম না। মাথা চুলকে বললাম এ্যাঁ, এ্যাঁ-এ্যাঁ-
প্রিয়াংকা হি হি করে হেসে বলল, তপুর তিন শব্দের সাথে চার নম্বর শব্দ যোগ হলো সেটা হচ্ছে এ্যাঁ!
প্রিয়াংকার আবু বললেন, আসলে এইটুকুন ছেলেকে অনেক বড় প্রশ্ন করে ফেলেছি তো–উত্তর দেবে কী ভাবে?
আমি বললাম, আপনি উত্তরটা দিয়ে দেন!
আমি দিলে সেটা তো আমার উত্তর হবে তোমার উত্তর হবে না?
আমি আবার মাথা চুলকে বললাম, এ্যাঁ, এ্যাঁ, এ্যাঁ…
সেটা শুনে প্রিয়াংকা আবার হি হি করে হেসে ফেলল। প্রিয়াংকার আব্বুও একটু হাসলেন, হেসে বললেন, আমার কয়েক জন খুব বিখ্যাত বন্ধু আছে, নাম বললে তোমরা চিনবে। আমি তাদেরকে খুব ভাল করে স্টাডি করেছি। করে কী দেখেছি জানো?
কী?
খ্যাতিটা গুরুত্বপূর্ণ না। যে গুণের জন্যে খ্যাতি এসেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই মিছিমিছি খ্যাতির পিছনে ছুটতে হয় না। মানুষ তো একটামাত্র জীবন পায়, সেই জীবনটাকে পুরোপুরি উপভোগ করতে হয়। তাই বলছিলাম একজন বিখ্যাত মানুষ হয়ে বিশেষ লাভ নেই কিন্তু একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে অনেক লাভ-
প্রিয়াংকা বলল, এই জন্যে আমি বাসায় কাউকে আনতে চাই না। সুযোগ পেলেই তুমি উল্টাপাল্টা কথা বলে মাথা আউলাঝাউলা করে দাও।
প্রিয়াংকার আব্বু বললেন, ঠিক আছে, আর আউলাঝাউলা করব না। তার চাইতে আমার লাস্ট বইটা নিয়ে আয়, তপুকে দেখাই।
কোন জ্ঞানের কথা বলতে পারবে না কিন্তু।
ভয় পাস না, বলব না।
প্রিয়াংকা তখন শেলফ থেকে তার আব্বুর লেখা বেশ কয়েকটা বই নামিয়ে আনল।
আমি যখন বিকালবেলা প্রিয়াংকার বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম তখন সে আমাকে একটু এগিয়ে দিতে এলো। আমি যখন বললাম কোন দরকার নেই তখন সে বলল মোড়ের দোকান থেকে তার নাকী ডিম আর তেল কিনতে হবে।
রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আমি বললাম, আচ্ছা প্রিয়াংকা, তোকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?
আবু কেন হুইল চেয়ারে সেটা জিজ্ঞেস করবি তো?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, হ্যাঁ।
আমি যখন ছোট তখন একটা গাড়ি একসিডেন্ট হয়েছিল। আম্মু স্পট ডেড। আর কোমর থেকে নিচে প্যারালাইজড।
আমি কিছুক্ষণ প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, তোর সাথে আমার একটা মিল আছে দেখেছিস?
কী মিল?
আমার বেলায় একসিডেন্টে আলু স্পট ডেড, আম্মু প্যারালাইজড! তোর আব্বুর শরীর আর আমার আম্মুর মন?
প্রিয়াংকা কোন কথা না বলে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল। আমি অন্যমনস্কভাবে চিন্তা করতে লাগলাম, কোনটা ভাল? শরীর অবশ হয়ে যাওয়া নাকী মন অবশ হয়ে যাওয়া?
১০. সারপ্রাইজ পার্টি
প্রিয়াংকা এটা ঠিক কীভাবে করে জানি না–আমাদের ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের যেদিন যার জন্মদিন সেদিন সে তার জন্যে একটা উপহার নিয়ে আসে। খুব যে একটা দামি উপহার আনে তা না–ছোটখাটো উপহার কিন্তু সে খুব ভাবনাচিন্তা করে সেটা আনে। জাবেদ হচ্ছে বইয়ের পোকা, তার জন্যে আনলো একটা বই এবং মজার কথা হচ্ছে এমন একটা বই যে বইটা জাবেদ পড়ার জন্যে অনেক দিন থেকে খুঁজছে এবং খুঁজে পাচ্ছে না। বইয়ের প্যাকেটটা খুলে সে যখন বইটা দেখলো তার মুখটা একেবারে একশ ওয়াট বালবের মতো জ্বলে উঠল! আমি তখন বুঝতে পারলাম প্রিয়াংকা কেন এটা করে–একজন মানুষের মুখ যখন আনন্দে একশ ওয়াট বালবের মতো জ্বলে ওঠে সেটা দেখার চাইতে মজার ব্যাপার আর কী আছে? আমাদের নীলিমা হচ্ছে একজন গায়িকা তার জন্যে প্রিয়াংকা আনলো একটা স্বরলিপির বই, বইটা পুরানো এবং পোকা খাওয়া। আমি ভেবেছিলাম এই বইটা দেখে নীলিমা নিশ্চয়ই একটু বিরক্ত হবেহলো ঠিক তার উল্টো, খুশিতে লাফাতে লাগলো কারণ সেটাতে নাকী দ্বিজেন্দ্রলালের কোন একটা হারিয়ে যাওয়া গানের স্বরলিপি আছে! আমাদের ইশতিয়াক হচ্ছে ক্রিকেটের ভক্ত, দুনিয়ার সব ক্রিকেটারদের নামধাম তার মুখস্থ। তাকে দিলো একটা সাইবার ক্যাফের কুপন পিছনে একটা ওয়েব সাইটের ঠিকানা। ঠিকানার নিচে প্রিয়াংকা লিখে দিয়েছে এখানে পৃথিবীর সমস্ত ক্রিকেটের খবর আছে! ইশতিয়াক ইন্টারনেট সাইবার ক্যাফে এসব কিছুই জানতো না, আরেকজনকে নিয়ে সেটা দেখে একেবারে হতবাক হয়ে গেলো! সারা জীবনের জন্যে সে প্রিয়াংকার ভক্ত হয়ে গেলো সাথে সাথে।
প্রিয়াংকার এই বিক্ষিপ্তভাবে আনন্দ প্রদান পদ্ধতিটা আমরা সবাই কমবেশি টের পেতে শুরু করেছি। বিষয়টা মনে হয় একটু ছোঁয়াচে, ক্লাসের আরও অনেকে দেখি সেটা করতে শুরু করেছে। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ইংলিশ মিডিয়াম সেই ছাত্রটার জন্যে আমাকে প্রাইভেট টিউটর বানিয়ে দেয়ার পর মাসের শেষে আমি যখন আড়াই হাজার টাকা পেলাম আমার প্রায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হলো! আমিও তখন একটু বিক্ষিপ্তভাবে আনন্দ প্রদান পদ্ধতি করার চেষ্টা করলাম–প্রিয়াংকা যেরকম অনেক দিন সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে আমি সেরকম পারি না তাই আমি এরকম জটিল কিছু করার চেষ্টা করলাম না, ক্লাসের সবার জন্যে মোড়ের দোকান থেকে জিলিপি কিনে নিয়ে এলাম। সবাই যখন কাড়াকাড়ি করে জিলিপি খেলো এবং জিলিপির রসে কারো হাত কারো বই খাতা এবং কারো জামা-কাপড় আঠা আঠা হয়ে গেলো সেটাও কম মজার ব্যাপার হলো না।
তবে আমরা কেউ প্রিয়াংকাকে হারাতে পারলাম না, আমরা যখন বিক্ষিপ্তভাবে আনন্দ প্রদান-এর চেষ্টা করি সেটা অনেক সময় হয়ে যায় জোর করে করা, সাজানো বা কৃত্রিম প্রিয়াংকা যখন করে সেটা হয় একেবারে স্বাভাবিক। দেখতে দেখতে প্রিয়াংকা মেয়েটার জন্যে ক্লাসের সবার এতো মায়া হয়ে গেলো সেটা আর বলার নয়। সেটা আমি বুঝতে পারলাম একদিন দুপুরবেলা যখন ক্লাসের সবচেয়ে কাঠখোট্টা ছেলে মুশফিক ঘ্যাস ঘ্যাস করে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমাদের প্রিয়াংকার জন্যে কিছু একটা করা দরকার!